যা আছে কেনেডি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত গোপন দলিলে

প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং ফার্স্ট লেডি জ্যাকুলিন কেনেডি। হত্যাকাণ্ডের মাত্র আধাঘণ্টা আগে তোলা ছবি।১৯৬৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আরও দুই হাজার ৮০০ গোপন নথি প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কেনেডিকে কেন হত্যা করা হয়েছিল তা নিয়ে নানা ধরনের 'ষড়যন্ত্রের' জল্পনা আছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব গোপন নথি প্রকাশের যুক্তি তুলে ধরে বলেন, জনগণের অধিকার আছে ঠিক কী ঘটেছিল তা জানার। কিন্তু সর্বশেষ দফায় সব গোপন নথি প্রকাশের কথা থাকলেও একেবারে শেষ মুহূর্তে কিছু নথির প্রকাশ স্থগিত রাখা হয়েছে 'জাতীয় নিরাপত্তার' অজুহাতে। যেসব নথি প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলোতে এই হত্যা রহস্য সম্পর্কে নতুন কী তথ্য আছে?

একটি নথিতে দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যাকারী লী হার্ভি অসওয়াল্ড নিজেই হত্যার হুমকির মধ্যে ছিল। এ ব্যাপারে পুলিশকে সতর্ক করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল তদন্ত সংস্থা এফবিআই।

এফবিআই এর তৎকালীন ডিরেক্টর এডগার হুভার নথিতে লিখেছেন, আমরা তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ প্রধানকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। পুলিশ প্রধান আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তাকে যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

লী হার্ভি অসওয়াল্ড ছিলেন একজন সাবেক মার্কিন মেরিন সেনা। তিনি নিজেকে 'মার্কসবাদী' বলে দাবি করতেন। প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর তাকে ডালাসের পুলিশ বিভাগের একটি কক্ষে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় তাকে আরও কড়া নিরাপত্তার একটি কারাগারে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। খবর সংগ্রহ করতে সেখানে জড়ো হওয়া সাংবাদিকদের এবং লাইভ টিভি ক্যামেরার সামনে তাকে গুলি করে হত্যা করেন ডালাসের একটি নাইট ক্লাবের মালিক জ্যাক রুবি।

বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা গোপন নথিগুলো এখন অনেকেই বিচার বিশ্লেষণ করে দেখছেন এতে কেনেডি হত্যকাণ্ড সম্পর্কে নতুন কোনও ক্লু পাওয়া যায় কিনা।

প্রকাশ করা একটি সিআইএ নথিতে দেখা যাচ্ছে, লী হার্ভি অসওয়াল্ড মেক্সিকো সিটিতে গিয়ে একজন কেজিবি অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এই কেজিবি অফিসারের কাজ ছিল অন্তর্ঘাত এবং গোপন হত্যাকাণ্ডে সাহায্য করা।

আরেকটি নথিতে দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যাকাণ্ডের পর সোভিয়েতদের মধ্যে এমন একটা আশঙ্কা ছিল, যে কোনও দায়িত্বজ্ঞানহীন মার্কিন জেনারেল হঠাৎ করেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করতে পারে। তা থেকে শুরু হয়ে যেতে পারে বড় আকারের যুদ্ধ।

আরেক নথিতে বলা হয়, ব্রিটেনের একটি আঞ্চলিক সংবাদপত্র, 'ক্যাম্ব্রিজ নিউজ' একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির কাছ থেকে একটি ফোন কল পেয়েছিল কেনেডি হত্যাকাণ্ডের অল্প আগে। তাতে যুক্তরাষ্ট্রে শিগগিরই একটি বড় খবর হতে যাচ্ছে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল।

১৯৯২ সালে মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল পাস করা হয়, যাতে কেনেডি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত সব গোপন দলিল ২৫ বছরের মধ্যে প্রকাশের অঙ্গীকার করা হয়। বৃহস্পতিবার সেই ২৫ বছর শেষ হয়েছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে সিআইএ-এর পক্ষ থেকে এফবিআই এবং পররাষ্ট্র দফতর সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার করা হয় কিছু নথি এখনই প্রকাশ না করতে। এর ফলে কেনেডি হত্যা রহস্য সম্পর্কে ষড়যন্ত্র এবং জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটানো কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

যেসব নথির প্রকাশ শেষ মূহুর্তে আটকে দেওয়া হয়, সেগুলো আগামী ছয় মাস ধরে পর্যালোচনা করে দেখার পর আগামী বছরের ২৬শে এপ্রিল পর্যন্ত গোপন রাখা হতে পারে।

যেভাবে কেনেডিকে হত্যা করা হয়:

১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর যখন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে হত্যা করা হয় তখন তিনি একটি ছাদখোলা লিমুজিনে চড়ে ডালাসের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই রাস্তার ওপর নজর রাখা যায় এমন একটি ভবনের জানালা দিয়ে লী হার্ভি অসওয়াল্ড গুলি করে তাকে হত্যা করেন। এমনটাই বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ারেন কমিশনের রিপোর্টে। তবে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়েছিল। ওয়ারেন কমিশন অবশ্য বলেছিল লী হার্ভি অসওয়াল্ড বা তাকে হত্যকারী জ্যাক রুবি আসলে কোনও বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল না। কিন্তু তারপরও কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে জল্পনা-কল্পনা থামেনি।

হত্যাকারী লী অসওয়াল্ড আসলে কে?

লী অসওয়াল্ড কেন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে হত্যা করতে গেলেন তা নিয়েও চালু আছে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। সাবেক মার্কিন মেরিন সেনা লী অসওয়াল্ড মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। সেখানে থাকেন ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। তিনি মেক্সিকো সিটিতে কিউবান এবং রুশ দূতাবাসে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ তাই মনে করেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে সোভিয়েত বা কিউবান ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।

অসওয়াল্ডের হত্যাকারী কে?

লী অসওয়াল্ডের হত্যকারী জ্যাক রুবি ছিলেন ডালাসের একটি নাইট ক্লাবের মালিক। কেন তিনি ডালাসের পুলিশ দফতরে ঢুকে লী অসওয়াল্ডকে গুলি করে মারলেন সেটাও একটা রহস্য। অনেকে মনে করেন, লী অসওয়াল্ডের কাছ থেকে এই ঘটনায় অন্য কোনও ব্যক্তির জড়িত থাকার তথ্য যেন জানা না যায়, সেজন্যেই তাকে হত্যা করা হয়।

জ্যাক রুবি অবশ্য দাবি করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যাকাণ্ডে তিনি মারাত্মক আঘাত পান। তার প্রতিশোধ নিতে অসওয়াল্ডকে হত্যা করেন। তার এই দাবি অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কারণ জ্যাক রুবির সঙ্গে অপরাধ জগতের মাফিয়াদের নানা রকম যোগাযোগ ছিল।

কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

বহুল প্রচলিত একটি তত্ত্ব হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর ডানপন্থীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রেসিডেন্ট কেনেডি নিহত হয়েছেন। এর সঙ্গে সিআইএ যুক্ত। অবশ্য ১৯৭৫ সালে রকফেলার কমিশন জানায়, এই হত্যাকাণ্ডে সিআইএ'র জড়িত থাকার কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই।

আরেকটি তত্ত্ব হচ্ছে, একজন নয়, দুজন বন্দুকধারী প্রেসিডেন্ট কেনেডির ওপর গুলি চালায়। লী অসওয়াল্ড আসল হত্যাকারী কিনা, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। বিশেষ করে যে ভবন থেকে তিনি গুলি করেছেন বলে বলা হয়, সেখান থেকে গুলি করে প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে হত্যা করা সম্ভব ছিল কিনা, সে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।