পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কি সৌদি আরবের ইরানবিরোধী তৎপরতায় সামিল হয়েছে?

সৌদি আরব-পাকিস্তান সামরিক সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় ঘনিষ্ঠ হওয়ার আভাস দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ এশিয়ান মনিটর। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা প্রায়ই সৌদি আরবে দায়িত্ব পালন করেন। আর সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ এখন রিয়াদভিত্তিক ৪১ জাতির ইসলামি সামরিক জোটের প্রধান। সাউথ এশিয়ান মনিটর বলছে, শরিফের পদলাভের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সৌদি আরবের ইরানবিরোধী পদক্ষেপে সামিল হয়েছে বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তারা শরিফের পদলাভকে ইসলামাবাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন বলতে নারাজ। ঘটনাটিকে শরিফের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা আখ্যা দিয়েছেন তারা। সমরনীতির বিশ্লেষকরা অবশ্য একে দুই দেশের সামরিক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা হিসেবেই দেখছেন।
সৌদি-পাকিস্তান সামরিক সম্পর্ক



সাউথ এশিয়ান মনিটর বলছে, গত ২৬ অক্টোবর সৌদি রাজকীয় স্থল বাহিনীর সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আল-সামান ৬ নামে তিন সপ্তাহের সামরিক মহড়া শেষ করে। মহড়ায় তাজা গোলাবারুদের ব্যবহার, গুপ্ত হামলা, টহল দান, আইইডি মোকাবিলায় বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩০তম কোরের কমান্ডিং অফিসার লে. জেনারেল আকরাম আল হক সার্বিক কমান্ডে ছিলেন। সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রিতে ব্যাপক আগ্রহ পাকিস্তানের। তাছাড়া পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচিতেও সৌদি সমর্থন পেয়েছে।
সাউথ এশিয়ান মনিটরের খবর অনুযায়ী, গত ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানের নেপথ্যে থাকা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। রিয়াদে সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ সম্মেলনের ফাঁকে এই বৈঠকটি হয়। জেনারেল বাজওয়া ৬ নভেম্বর তেহরান সফর করেন বলে সাউথ এশিয়ান মনিটরকে জানিয়েছে কূটনৈতিক সূত্র। সফরকালে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি এবং পাকিস্তানের সরকারি মহাকাশ সংস্থা সুপারকোতে ইরানি বিজ্ঞানীদের সফর নিয়ে আলোচনা করেন। সৌদিদের সাথে পাকিস্তানের গভীর সম্পৃক্ততা নিয়ে ইরানি উদ্বেগ প্রশমিত করার চেষ্টাতেই এই সফর ছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে।
রাওয়ালপিন্ডিতে সৌদি উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল-আয়াশের সাথে জেনারল বাজওয়ার বৈঠকের দুই মাসের মধ্যে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গের বৈঠকটি সম্পন্ন হলো। বিন আবদুল্লাহর সাথে বৈঠকে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে সাউথ এশিয়ান মনিটর জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি নিরাপত্তায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে রিয়াদের মধ্যে জরুরি তাগিদ দেখা গেছে।
খবর অনুযায়ী, দুটি কাজে ইসলামাবাদের সামরিক সম্পদের সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে: নিজের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শরিফের নেতৃত্বাধীন ইসলামি সামরিক জোটে (আইএমএটি) পাকিস্তানের অংশগ্রহণ।

রিয়াদ এই সামরিক জোটে ‘কেবলমাত্র সুন্নি’ সামরিক সদস্যদের নেওয়ার জন্য চাপ দিলে জেনারেল রাহিল শরিফ এটিকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বিবেচনা করে পদত্যাগ করতে যাচ্ছিলেন বলে গুজব রয়েছে। কিন্তু তিনি নিজেই এই গুজব নাকচ করে দিয়েছেন গত মাসে ‘মিডল ইস্ট মিলিটারি অ্যালায়েন্স অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন কনফারেন্সে।’ তিনি বলেছেন, ‘কমান্ডার হিসেবে সৌদি-নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে অংশগ্রহণ আমার জন্য সম্মানের।’
পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন, জেনারেল শরিফের সম্পৃক্ততা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন নয়। পাকিস্তানের সিনিয়র এক কর্মকর্তা এশিয়া টাইমসকে বলেন, জেনারেল রাহিল শরিফ ব্যক্তিগতভাবে আইএমএটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের সরকারি নীতির প্রতিফলন নয়। অবশ্য তার পরও তার এ ধরনের যেকোনো পদক্ষেপই ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আমরা নিশ্চিত, তিনি বিষয়টি জানেন। তিনি বলেন, জেনারেল রাহিল শরিফ আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন, তিনি বিশেষ কোনো দেশের বিরুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন না। বরং তিনি আইএসআইএসের মতো গ্রুপের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব লে. জেনারেল তালাত মাসুদ এশিয়া টাইমসকে বলেন, শরিফ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক না রেখে নিজের মতো করে কাজ করছেন। তার লক্ষ্য সৌদি বাহিনীকে আরো ভালো অস্ত্রে সজ্জিত করা। তিনি বর্তমানে সৌদি সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর কাজে সহায়তা করছেন। এই বাহিনী শেষ পর্যন্ত আইএমআইটির অংশে পরিণত হবে। তিনি সৌদি আরবে মোতায়েন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন না। এই বাহিনী সৌদি অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ।
দি মিলিটারি অ্যান্ড পলিটিক্স ইন পাকিস্তান গ্রন্থের লেখক সামরিক বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভি এশিয়া টাইমসকে বলেন, সৌদি আরবে নিয়োজিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সম্পৃক্ততা মূলত প্রশিক্ষণকেন্দ্রিক। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নানা ধরনের সহায়ক কাজ করে থাকে। কারণ এই অঞ্চলে কোনো পেশাদার বাহিনী নেই। তুরস্কের সেনাবাহিনীকে বাদ দিলে এই অঞ্চলের বেশির ভাগ সেনাবাহিনীই আলঙ্কারিক। ফলে সঙ্ঘাত হলেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্বাভাবিকভাবেই মূল ভূমিকায় চলে আসে।
সাউথ এশিয়ান মনিটরের দাবি, বেসামরিক ও সামরিক উভয় বিভাগের কর্মকর্তারা রিয়াদের কাছে পাকিস্তান তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথা সুস্পষ্টভাবে বলে এলেও বাস্তবে ইসলামাবাদ বলতে গেলে সৌদি পক্ষ নিয়েই কাজ করছে। অবসরপ্রাপ্ত এক সামরিক কর্মকর্তা ওই সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ইরান, ইয়েমেন, কাতার বা লেবাননে হামলায় পাকিস্তানি সৈন্যরা শারীরিকভাবে জড়িত না হলেও বাস্তবতা হলো আমরা সৌদি যেহেতু সৌদি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অভ্যন্তরীণভাবে জোরদার করছি, তা-ই তাদের দলের অনিবার্য অংশে পরিণত হয়ে গেছি।’