অবশেষে দেশে ফিরলেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হারিরি

সৌদি আরবে গিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পার করে দেশে ফিরলেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। মঙ্গলবার রাতে রাজধানী বৈরুতের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। বুধবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এবং তেহরানভিত্তিক পার্স টুডে তার দেশে ফেরার খবর নিশ্চিত করে। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তাকে অপহরণ করার অভিযোগ এনেছিল তার দেশ। রাজনীতিবিশ্লেষকরাও তার পদত্যাগের নেপথ্যে সৌদি চাপকেই কারণ মনে করেন।দেশে ফিরলেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী

সৌদি আরব সফরে গিয়ে এক টেলিভিশন ভাষণে নিজের পদত্যাগের কথা ঘোষণা করার ১৮ দিনের মাথায় তিনি নিজ দেশে ফিরলেন হারিরি। আল জাজিরার খবর থেকে জানা গেছে, ব্যক্তিগত বিমানে তিনি বৈরুত বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সে সময় লেবাননের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা তাকে স্বাগত জানান। এর আগে তিনি সাইপ্রাসে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করে দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোস অ্যানাসতাসিয়াদসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

গত ৪ নভেম্বর সৌদি আরব সফরে গিয়ে হঠাৎ করেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন সাদ হারিরি। পদত্যাগের কারণ হিসেব প্রাণভয়ের কথা উল্লেখ করেন তিনি। এজন্য দায়ী করেন ইরান ও হিজবুল্লাহকে। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা সৌদি আরবের চাপেও পদত্যাগ করেছেন হারিরি। তবে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেও লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন প্রধানমন্ত্রী হারিরির পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি এবং তাকে বৈরুতে ফিরে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়েছেন। সম্প্রতি হারিরি বলেছেন, বৈরুত পৌঁছার আগ পর্যন্ত তিনি নিজের পদত্যাগ নিয়ে কোন কথা বলবেন না। আল জাজিরা জানিয়েছে, তিনি বুধবার লেবাননের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন।

পার্স টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইপ্রাস সফরের আগে মঙ্গলবার সাদ হারিরি মিসর সফরে যান এবং সেখানে দেশটির প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আস-সিসির সঙ্গে বৈঠক করেন। কায়রোয় এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে হারিরি তার প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য সিসি’কে ধন্যবাদ জানান।

পদত্যাগের কথা ঘোষণা করার পর টানা দুই সপ্তাহ রিয়াদে অবস্থান করেন হারিরি। এরপর গত শনিবার তিনি রিয়াদ থেকে প্যারিসে যান এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার সময় লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি হিজবুল্লাহ ও ইরানকে আক্রমণের নিশানা বানিয়েছিলেন। রিয়াদে সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচারে নিজের জীবননাশের আশঙ্কা জানিয়েছিলেন তিনি। লেবাননের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ এ দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, সৌদি আরবের চাপেই পদত্যাগ করেছেন সাদ হারিরি। হারিরি যে বিবৃতিটা পড়েছেন সেটাও সৌদির লিখে দেওয়া বলে দাবি করেন তিনি।

লেবাননের প্রেসিডেন্টসহ দেশের বেশিরভাগ মানুষও মনে করেন, হারিরির পদত্যাগের পেছনে সৌদি আরবের হাত রয়েছে। কারণ হিসেবে মনে করা হয়,  লেবাননে ইরানের প্রভাব কমাতে ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে চায় সৌদি আরব। হিজবুল্লাহকে দমন করতে লেবাননকে নিশানা বানিয়েছে সৌদি আরব। দেশটির ধর্মভিত্তিক ক্ষমতায়নের ভারসাম্য ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আরও একটি পররাষ্ট্রনৈতিক সফর চালাতে চাইছে রিয়াদ। সৌদি প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত খুব একটা সফল হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।বস্টনের নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির মিডল ইস্ট সেন্টারের সহ-পরিচালক ডেনিস সুলিভান বলেন, সশস্ত্র গোষ্ঠীটি অক্ষত অবস্থায় সংকট উতরে গেলে সংগঠনটির প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ ‘কোনও কিছু না হারিয়েই জিতে যাবেন’। 

গত দুই সপ্তাহে ধরে সুন্নিপন্থী সৌদি আরব ও শিয়াপন্থী ইরানের মধ্যে চলছে ছায়াযুদ্ধ। আধিপত্য বিস্তারের খেলায় মেতেছে মধ্যপ্রাচ্যের দুই পরাশক্তি। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরানকে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে আসছে সৌদি আরব। সৌদি আরবের আশঙ্কা, ইরান তাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। ইরাকযুদ্ধ ও আরব বসন্তের সুযোগ নিয়ে বাড়াতে পারে আঞ্চলিক প্রভাব। বাগদাদ, দামেস্ক, সানা ও বৈরুতের ধারাবাহিকতায় তেহরান মধ্যপ্রাচ্যের বাদবাকি দেশগুলোকে নিজেদের কব্জায় নিতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে সৌদি আরবের। এই বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করার লড়াইয়ে নেমেছে তারা। দেশের অভ্যন্তরে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের নামে আর ইরানঘনিষ্ঠ  ইয়েমেন-লেবাননের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগ তুলে তেহরানবিরোধী ছায়াযুদ্ধ শুরু করে সৌদি আরব। এরই অংশ হিসেবে ৪ নভেম্বর পদত্যাগ করেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি।

লেবাননের রাজনৈতিক রম্য কবি আবদাল রহিম আল-আউজি বলেন, ‘ফারাও-রোমানদের সময় থেকে এটা চলে আসছে। শুধু সৌদি নয়, ইরান, আমেরিকা সবাই আমাদের উপর হস্তক্ষেপ করে।’