জঙ্গি তৎপরতায় নাঈমুর-ইমরান: উদ্বেগে যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা



ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টায় জেলহাজতে থাকা ব্রিটিশ বাংলাদেশি নাঈমুর জাকারিয়া রহমান গত শুক্রবার ব্রিটেনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তার সহযোগী আদিব ইমরানও স্বীকার করেছে, তারা আইএসে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
এদিকে তাদের স্বীকারোক্তির খবর গত দুদিন ধরে ফলাও করে প্রচার করছে ব্রিটিশ মিডিয়া। সব খবরেই ফলাও করে প্রচার হচ্ছে নাঈমুরের 'ব্রিটিশ বাংলাদেশি' পরিচয়টি।  খবরটি উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের। বিষয়টিকে বিব্রতকরও বলছেন তারা। প্রবাসীদের মন্তব্য, এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে তার প্রভাব পড়তে পারে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রবাসীদের ওপরেও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা ও বর্তমানে লন্ডনের ক্রয়োডনে বসবাসরত ফয়সল রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ব্রিটেনে ইসলামি জঙ্গিবাদ বিস্তারের শুরুর দিকে কখনও বাংলাদেশি কমিউনিটির কোনও ধরনের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। গত কয়েক বছরে আমরা দেখলাম কিছু ব্রিটিশ বাংলাদেশি স্কুলছাত্রীরা জিহাদের নামে সিরিয়ায় পাড়ি জমালেন। তাদের ভুল বুঝিয়ে, ব্রেনওয়াশ করে শুধু যে তাদের বা তাদের পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে, সেটি শুধু নয় কিন্তু। তাদের ব্রিটিশ বাংলাদেশি পরিচয়টি ব্রিটেনে বাংলাদেশির গৌরবের পরিচয়েও লজ্জার কালিমা এঁকে দিয়েছে।
বর্তমানে আমেরিকা সফররত চ্যানেল আই ইউরোপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী সোয়েব সোমবার সকালে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমেরিকায় বাংলাদেশি সন্ত্রাসী আকায়েদের ঘটনায় এখানে পুরো বাংলাদেশি কমিউনিটি বিব্রত। আমেরিকায় পারিবারিক ভিসা বন্ধ হতে পারে এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশিত হচ্ছে মার্কিন মিডিয়াগুলোতে। প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি ফ্যামেলি ভিসায় আমেরিকায় আসছেন। ফ্যামেলি ভিসা বন্ধ হলে বাংলাদেশিরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সোয়েব আরও বলেন, প্রায় ত্রিশ বছর ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছি। এদেশের স্যোশাল ওয়েলফেয়ার বেনিফিট সিস্টেম আজ যারা তরুণ তাদের শতকরা নিরানব্বই ভাগের খাবার, ওষুধ, কাপড়- চোপড় জুগিয়েছে। এদেশের  ফ্রি স্কুলেই তাদের লেখাপড়ার হাতে-খড়ি। তবু তারা মানুষ খুন করতে যায় জিহাদের নামে। তার নিজ দেশেরই মানুষকেই। যুদ্ধ করে জিহাদের নামে নিজ জন্মভূমির বিরুদ্ধে। সবশেষ দেখলাম, আক্রান্ত করতে চায় নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি বলেন, এ ঘটনার পেছনে একটি সংঘবদ্ধ মৌলবাদী চক্রের দায় আছে।  তেমনি ব্রিটেনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের শিকার হচ্ছেন এথনিক মাইনোরিটি কমিউনিটি হিসেবে ব্রিটিশ বাংলাদেশিরাও। কিন্তু, এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের কমিউনিটির জন্য গভীর উদ্বেগের। এসবে জড়িয়ে পড়া কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তি ধর্মকে অপব্যাখ্যা করে কথিত জিহাদের নামে, এতে তারা শুধু নিজেরা নিজেদের বা পরিবারকে আক্রান্ত করছে, সেটাই নয়। ব্রিটেনের বহুজাতিক বহুবর্ণের সমাজে তাদের নামের আগে খবরের কাগজে বা টিভিতে  বলা হয় 'ব্রিটিশ-বাংলাদেশি'। তাদের ব্যক্তিগত সন্ত্রাসের দায় শুধু ধর্মকে নয়, প্রবলভাবে আক্রান্ত করছে দেশটিতে প্রায় একশত বছর ধরে স্বকীয় মর্যাদায় বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটিকেও। তারা এখন ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে এমন এক সন্দেহের তালিকায় পৌঁছে দিচ্ছেন, যেখানে অতীতে কেবল ছিলেন ব্রিটিশ পাকিস্তানিরা।
ব্রিটেনে প্রায় ৩৫ বছর ধরে বসবাস করে ও কলেজে শিক্ষকতা করছেন ড. রেনু লুৎফা। বর্ষীয়ান এ সাংবাদিক ও কবি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,
ইদানিং আমেরিকা ও বৃটেনে ধর্মীয় উগ্রপন্থী বাংলাদেশি যুবকদের ধর্মীয় উন্মাদনায় নিরীহ বাংলাদেশিদের অবস্থান একবারেই নাজুক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই  মুসলমানদের আমেরিকার বাইরে রাখার ঘোষণা দেন। সম্প্রতি বাংলাদেশি আকায়েদের উগ্র আচরণে ইমিগ্রেশন আইনেও রদবদল করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু ঘোষণা দিলেই তো আর চলে না। কংগ্রেসে বিল পেশ করে ভোটের মাধমে পাশ করতে পারলেই শুধু আইন করা হবে। বাংলাদেশি উগ্রপন্থী যুবক এবং তরুণীদের ধর্মান্ধতায় পশ্চিমা দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা সঙ্গত কারণেই উদ্বিগ্ন। পশ্চিমা দেশগুলোতে বাংলাদেশকে কালো তালিকাভুক্ত করা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বাংলাদেশ সরকারকেও এ নিয়ে চিন্তা
ভাবনা করতে হবে। পাশাপাশি অশিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত তথাকথিত ধর্মীয় শিক্ষকদের এক হয়ে রুখতে হবে।’
মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব বিশেষ করে সৌদি ওহাবী গ্রুপ যে হারে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রভাবিত করছে তা গভীর উদ্বেগজনক।
কমিউনিটি নেতা ও আইনজীবী সলিসিটর বিপ্লব কুমার পোদ্দার বলেন, জঙ্গিবাদ যেন ব্রিটেনে বাংলাদেশির অর্জনকে ম্লান না করে দিতে পারে সেজন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখনই সময়। আমাদের যার যার জায়গা থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেকের সন্তানটি কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে সেদিকে লক্ষ্য রাখা খুব জরুরি।
বাম রাজনীতিক ও সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা নুরুর রহিম নোমান বলেন, ব্রিটেনে আলতাব আলীর মতো বাংলাদেশিরা জীবন দিয়ে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আজ আমাদের সন্তানরা এদেশে মূলধারায় পৌঁছেছে। পার্লামেন্টে তিন তিন জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি। আমাদের কমিউনিটির জঙ্গিবাদবিরোধী ঐক্য ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা এখন এদেশে আমাদের ভবিষ্যত রক্ষার বড় চ্যালেঞ্জ।