শরিয়াভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিন-এর পতাকাকে আশ্রয় করে কিছুদিন আগে কাশ্মিরের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন বুরহান ওয়ানি। তার মতো শিক্ষিত-উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানের ‘শহীদ’ হওয়ার ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল ভারতবর্ষ। ৬ মে (রবিবার) ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিয়েছে, স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল হয়ে ভারতীয় বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন মোহাম্মদ রাফি ভাট নামের একজন কাশ্মিরি অধ্যাপক। সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য, সমাজতত্ত্বের এই শিক্ষকও একই সংগঠনের পতাকাকে আশ্রয় করেছেন। কাশ্মিরের তিন যুগের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের রেকর্ড ঘেঁটে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, আত্মাহুতি দেওয়া কাশ্মিরিদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিত। এই ঘটনা যে ভারতীয় স্টাবলিশমেন্টকে ভয়াবহভাবে ভাবিয়ে তুলেছে, সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে এরইমধ্যে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
রাফি'র পরিচিতজনরা স্মৃতি হাতড়ে বের করে এনেছেন তার যাপনের নানা তথ্য। সেখান থেকেই জানা গেছে, কার্ল মার্ক্সের বস্তুবাদী তত্ত্বে শনাক্তকৃত ধর্মের অবস্থান নিয়ে এক সময় তুমুল আলোচনায় মেতে থাকতেন সমাজবিজ্ঞানের এই মেধাবী শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও তার চমৎকার সম্পর্কের খবর মিলেছে সংবাদমাধ্যমে। ‘শহীদ’ হওয়ার আগে তিনি নিজেও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে লিখে গেছেন শিক্ষার্থীদের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার কথা। এমন মানুষের সশস্ত্র শরিয়াভিত্তিক সংগঠনে ঝুঁকে পড়ার খবরে যারপরনাই বিস্মিত তার চেনাজানা মানুষেরা। পরিবারের অতীত ইতিহাসেও এমন নজির রয়েছে বলে রাফির বাবার অবশ্য তেমন বিস্ময় নেই। একই সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের পতাকাতলে শামিল হয়ে ‘শহীদ’ হয়েছিলেন রাফির দুই চাচাত ভাই। তবে রাফি যেন সেই পথ অনুসরণ না করে, তার জন্য চেষ্টার ঘাটতি ছিল না তার বাবার। ছেলেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে চেয়েছেন তিনি। কাশ্মিরের অপরাপর বহু গরিব তরুণের মতো বেহাল অবস্থা ছিল না রাফির। উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকতার কথিত মহান পেশা রাফিকে সশস্ত্র পন্থার ঝোঁকমুক্ত রাখবে বলেই বিশ্বাস রাখতেন তার বাবা। তবে সেই বিশ্বাস ভেঙে পড়েছে পৃথিবীর অন্যতম সামরিকায়িত ভূখণ্ড জম্মু-কাশ্মিরে। মার্ক্সবাদী সমাজতত্ত্বের আলোচনায় মেতে থাকা রাফি শেষ পর্যন্ত শরিয়াভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠনকেই আশ্রয় করেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চলে গেছেন ‘মহান আল্লাহ’র সান্নিধ্যে।
কোথায় বসে মার্ক্সবাদ চর্চা করতেন রাফি? সেই জম্মু-কাশ্মিরের মাটিতে; মানবাধিকার সংস্থা, ইতিহাসবিদ আর রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে যে স্থানটি ক্রমেই ভারত-পাকিস্তানের সমরাস্ত্র প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মানবাধিকারকর্মীদের দাবি অনুযায়ী, ’৪৭-এর পর থেকে অন্তত পাঁচ লাখ কাশ্মিরি নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও ১০ লাখের মতো। খোদ সরকারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রভাবশালী ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে কেবল ১১ বছরেই ৪৩ হাজার ৪৬০ জন কাশ্মিরি নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। আর মানবাধিকার কর্মীদের দাবি অনুযায়ী, ওই ১১ বছরে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আরও এক লাখ।
সম্প্রতি এই সেনাসমাবেশ আরও বেড়েছে। পোল্যান্ডের ওয়ারসতে অবস্থিত সমাজবিজ্ঞান ও কলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আগ্নিয়েস্কা কুশাস্কা বলছেন, বিজেপি সরকার দমননীতিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ডয়চে ভেলেকে গত বছরের মে মাসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, ‘কাশ্মিরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আন্দোলনের একাংশ আরও বেশি করে চরমপন্থী হয়ে উঠবে; যদি না ভারতের শাসক দল বিজেপি তাদের দমননীতি থেকে সরে আসে।’ বাস্তবে বিজেপির দমননীতি বন্ধ হয়নি। পোলিশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন-এর বোর্ড সদস্য এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের সদস্য আগ্নিয়েস্কার আশঙ্কাও তাই মিথ্যে হয়নি।
২০১৬ সালের ৮ জুলাই (শুক্রবার) ভারতীয় বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান হিজবুল মুজাহিদিনের তৎকালীন কমান্ডার বুরহান মুজাফফর ওয়ানি। শিক্ষিত তরুণ বুরহান সশস্ত্র বিদ্রোহী কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন মৃত্যুর পর। শ্রীনগরের রাইজিং কাশ্মির পত্রিকার সম্পাদক সুজাত বুখারি সে সময় বিবিসিতে ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। বুরহানের প্রতি তরুণ কাশ্মিরিদের দুর্বার আকর্ষণবোধের নেপথ্য কারণের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের কথা। ওই নির্বাচনে পিপল’স ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-পিডিপির মেহবুবা মুফতি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জোট গড়েছিলেন হিন্দুত্ববাদী শাসক দল বিজেপি’র সঙ্গে। সুজাতের মতে, এই ঘটনাই কাশ্মিরের জনগণের মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের তাগিদ তৈরি করেছিল।
সুজাত বিবিসি’কে জানিয়েছিলেন, বুরহান ছিলেন শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। অন্য সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মতো করে মুখোশের আড়ালে মুখ ঢেকে রাখেননি তিনি। ২০০৮ ও ২০১০ সালে কাশ্মিরীদের ওপর ভারতীয় বাহিনীর তীব্রতর দমনপীড়নের স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নেমেছিলেন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবিতে। বুরহানের মৃত্যুর পরের দিন ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় টুইটার পোস্টে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ লেখেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে বুরহান যতো মানুষকে জঙ্গিবাদে ভেড়াতে পারতেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষেকে যুক্ত করতে পারবেন কবর থেকে।’ ঘটনাকে সত্য প্রমাণ করে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্ট তাদের শিরোনাম লেখে: বুরহানের মৃত্যু উজ্জ্বীবিত করেছে এক নতুন ধারার সশস্ত্র প্রতিরোধকে, হাতে বন্দুক তুলে নিচ্ছে তরুণরা। ৭ মে অধ্যাপকের ‘শহীদ’ হওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ৮ মে (মঙ্গলবার) সম্প্রচারমাধ্যম এনডিটিভি খবর দিয়েছে, অভ্যন্তরীণ সশস্ত্রপন্থীদের তৎপরতায় কাশ্মিরে উদ্বেগ বাড়ছে। কাশ্মির বিশ্লেষক শেখ শওকত হুসাইন তাই ওয়াশিংটন পোস্টকে যথার্থই বলেছেন, রাফির জঙ্গিবাদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে কাশ্মিরি তরুণদের মনে ভারতীয় সরকারে বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভেরই প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘তরুণদের মনে একটা পরিবর্তন এসেছে। তারা ভাবছে, ব্যাপক বিক্ষোভও কোনও কাজে আসছে না। তাই স্বাধীনতা পেতে তাদের অস্ত্র ধরতে হবে।’