সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানকে এগিয়ে রাখছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম

বেশ কিছুদিন ধরেই গুঞ্জন উঠেছে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সে দেশের বিচার বিভাগের সহায়তায় সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের দল তেহরিক ই ইনসাফকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বেশি হওয়া সত্ত্বেও তাই ইমরান খানকেই সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এগিয়ে রেখেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। প্রাক নির্বাচনি জরিপগুলোর বরাত দিয়ে এই নির্বাচনে হাড্ডহাড্ডি লড়াইয়ের আশা করা হলেও ইমরানের দলই সরকার করতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। নির্বাচনি পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়েছে তারা।পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি চেয়ারম্যান ইমরান খান
বুধবার (২৫ জুলাই) সকাল আটটা থেকে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন ও চারটি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলছে। প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রেকর্ড সংখ্যক সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর ৩ লাখ ৭১ হাজারের বেশি সেনা মোতায়েন থাকছে। একই সঙ্গে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর আরও সাড়ে ৪ লাখের বেশি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। দেশজুড়ে ১৭ হাজার ভোটকেন্দ্রকে ‘স্পর্শকাতর’ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এতো কঠোর নিরাপত্তা সত্ত্বেও ভোটগ্রহণ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মাথায় বেশ কয়েকটি জায়গার সহিংসতার খবর মিলেছে।
বুধবার সকালে জাতীয় পরিষদের ৫৩নম্বর আসনের একটি ভোট কেন্দ্রে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খান। এই নির্বাচনকে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়ে সব ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ভোটকেন্দ্রে সংবাদমাধ্যমের সামনে ব্যালট পেপারে সিল দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে একটি নোটিশ আমলে নিয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনি গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণ হলে তার ভোট বাতিল হতে পারে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক চ্যানেলনিউজ এশিয়া বলছে এই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না কোনও দল। ভোটকেন্দ্রের সর্বশেষ মতামতের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি বলছে ইমরানের পিটিআই ও নওয়াজের পিএমএল-এন খুব কাছাকাছি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। অবশ্য জাতীয় নির্বাচনে ইমরান খান এগিয়ে থাকলেও দেশটির সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবে তার অবস্থানে খানিকটা ভাটা পড়েছে। সাম্প্রতিক জরিপে সেখানে এগিয়ে আছে শরিফের দল।
পেশোয়ারে ভোট দিয়ে ফেরা ৩১ বছর বযসী তোফায়েল আজিজ বলেছেন, ‘দেশের গন্তব্য পরিবর্তনের একমাত্র আশা ইমরান খান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ে সমর্থন জানাতেই আমরা এখানে হাজির হয়েছি।’
প্রায় ১০ কোটি ৬০ লাখ ভোটার বুধবারের সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেবে। সকাল থেকে শুরু হওয়া ভোটগ্রহণ শেষ হবে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায়। তার একঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল প্রকাশ শুরু হবে। রাত দুইটার দিকে চূড়ান্ত বিজয়ী কে হচ্ছেন তা জানা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভারতের সম্প্রচারমাধ্যম এনডিটিভি তাদের ওয়েবসাইটে লিখেছে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিশ্চিত না হলেও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সবচেয়ে ভালো সুযোগ রয়েছে ইমরান খানের। সমালোচকেরা অবশ্য তাকে এই পদের অযোগ্য বলে মনে করেন। তালেবানদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়ার পর অনেকেই তাকে ‘তালেবান খান’ নামেও অভিহিত করে থাকেন। আবার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনি প্রচারণায় এগিয়ে রয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের ২৭২ আসনের বিপরীতে লড়ছেন ৩ হাজার ৪৫৯জন প্রার্থী। চারটি প্রাদেশিক পরিষদ পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং খাইবার –পাখতুনওয়ালার ৫৭৭টি সাধারণ আসনের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন ৮ হাজার ৩৯৬জন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ওয়ানইন্ডিয়া বলেছে, নির্বাচনি প্রচারণার সময়ে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের ওপর নানা চাপ প্রয়োগ হয়েছে। ইমরানের নির্বাচনি প্রচারণায় গোপনে সমর্থন দিয়েছে সেনাবাহিনী। আর তার বিরোধীদের বানানো হয়েছে লক্ষ্যবস্তু। পাঞ্জাবে পিএমএল-এন ও পিটিআইয়ের মধ্যে কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দিয়ে ওয়ানইিন্ডয়া লিখেছে এই প্রদেশে বিজয়ী দল প্রায়ই পরবর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
ওয়ান ইন্ডিয়া বলেছে, কয়েকটি জরিপ ইমরানকে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে রাখলেও বেশিরভাগ জরিপই হাড্ডহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে ইমরানের জয়ের আশা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে নওয়াজের পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন)। আর তৃতীয় অবস্থান থাকবে সাবেক প্রধনামন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি বলছে, কোনও দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সেক্ষেতে কঠোর ধর্মীয় মতাদর্শের দলগুলো মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে পারে। সেক্ষেত্রে ইমরানের দলের সরকার গঠনের সম্ভাবনা বেশি।
মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদমাধ্যম গালফ নিউজ এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছে, পাকিস্তানের রাজনীতির সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে ইমরান খান পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে নওয়াজ আর বিলাওয়ালের দলও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। গালফ নিউজ’র বিশ্বাস পাকিস্তানে আরেকটি জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি লিখেছে, ইমরান খান এবং পিটিআই এই নির্বাচনে ভালো করছে। গত সপ্তাহে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, অন্যরা প্রার্থীরা তাদের অতীত রেকর্ডের কারণে হেরে যাবেন। দুর্নীতি বিরোধী লড়াইকে প্রচারণাকে সঙ্গী করে প্রার্থী হওয়া ইমরান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কোনও ধরনের যোগসাজশের কথা অস্বীকার করে আসছেন।
স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় সেনা আধিপত্য দৃশ্যমান। দেশটির ৭০ বছরের শাসনের ইতিহাসে এবারের মুসলীম লীগ সরকার দ্বিতীয় নির্বাচিত সরকার, যারা পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হয়েছে। এরইমধ্যে নওয়াজ শরিফের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষিত হওয়া এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাজা ঘোষণার বিচারিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যোগসাজশের খবর মিলেছে। এদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের অভিযোগ ক্রমশই জোরালো হতে শুরু করেছে। বিচারবিভাগ ও সেনাবাহিনীর যোগসাজশে নতুন নেতৃত্বকে ক্ষমতায় আনা হবে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া কালো ছায়ায় ঢেকে যেতে পারে।