রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে গণহত্যা বললো মার্কিন কংগ্রেস, বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংসতাকে 'গণহত্যা' আখ্যা দিয়েছেন মার্কিন আইনপ্রণেতারা। বৃহস্পতিবার (১৩ ডিসেম্বর) মার্কিন কংগ্রেসের নিম্ন কক্ষ- প্রতিনিধি পরিষদে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাস করেছেন তারা। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে 'গণহত্যা'র স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ জোরালো হয়েছে। নিম্ন কক্ষের পর কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ সিনেটেও প্রস্তাবটি পাস হলে সে চাপ আরও জোরালো হবে। রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে তখন আইনগতভাবে গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হবে মার্কিন প্রশাসন। আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এ স্বীকৃতি খুব জরুরি। আন্তর্জাতিক আদালতের বিধান অনুযায়ী কেবল জাতিগত নিধনের কারণে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারেরও প্রশংসা করেছেন কংগ্রেস সদস্যরা। 

মার্কিন কংগ্রেস
গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আর বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা স্যাটেলাইট ইমেজ আর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে হত্যা-ধর্ষণ-ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত তুলে আনলেও মিয়ানমার ওই অভিযোগকে ‘অতিকথন’ কিংবা ‘গুজব’ আখ্যায়িত করে উড়িয়ে দেয়। জাতিসংঘ এরইমধ্যে মিয়ানমারে সংঘটিত রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও মানবাধিকার কমিশন শুরু থেকেই সোচ্চার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে। চীন-রাশিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও নিরাপত্তা পরিষদও সহিংসতার অবসান ঘটানো এবং রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধের তাগিদ দেয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইট ওয়াচসহ বিভিন্ন সংগঠন ও রাষ্ট্রও সোচ্চার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও দেশটি রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়নি। বরাবরই এ ব্যাপারে আইনি সিদ্ধান্ত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে শুধু ‘জাতিগত নিধন’ পর্যন্তই বলতেই রাজি আছেন তিনি। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো কখনও প্রকাশ্যে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথাই বলেননি। জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় জাতিগত নিধনযজ্ঞকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সমান্তরাল মনে করা হয় না। আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এটি কোনও স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও জাতিগত নিধনকে গহণহত্যা বিবেচনা করে না। এটিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই শুধুই জাতিগত নিধন মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেও বিবেচিত হয় না। সে কারণে রাখাইনের ঘটনায় ‘জাতিগত নিধনে’র অভিযোগ আনলে যুক্তরাষ্ট্রকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে না। 

মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে গত বছর বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা
ট্রাম্প প্রশাসনের অনীহা থাকলেও মার্কিন আইন প্রণেতাদের অনেকে রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে। এ নিয়ে চলছে তৎপরতাও। বৃহস্পতিবার মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করতে ভোটাভুটি হয়। এদিন ৩৯৪-১ ভোটে পাস হয় প্রস্তাবটি। কংগ্রেস সদস্য ও হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস বলেন, প্রস্তাবটি পাসের মধ্য দিয়ে প্রতিনিধি পরিষদ তার অংশের দায়িত্বটুকু পূরণ করেছে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে রয়েস বলেন, ‘এসব নৃশংসতা সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে ঘর ছেড়ে বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য করেছে। সেখানে এখন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করে বাংলাদেশ উদারতা দেখিয়েছে।’ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত নৃশংসতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যা আখ্যা দিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকেও অনুরোধ জানানো হয়েছে ওই প্রস্তাবে। পাশাপাশি মিয়ানমারে কারাবন্দী দুই রয়টার্স সাংবাদিককে অবিলম্বে ক্ষমা ও মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রতিনিধি পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দেওয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন, বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর ওপর চাপ জোরালো হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার এড রয়েস বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এসব অপরাধকে গণহত্যা আখ্যা দেওয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে। তা করতে ব্যর্থ হলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে এবং দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে।'  

সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তবে ওই প্রতিবেদন রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন রয়েস। তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্র দফতরের ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নিপীড়নের অনেক আলামতের কথা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে প্রত্যক্ষদর্শী এক নারীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, মিয়ানমারের সেনাদেরকে নবজাতক ও শিশুদের নদীতে ছুড়ে ফেলতে দেখেছেন তিনি। সন্তানদের বাঁচানোর চেষ্টা করলে তাদের মায়েদেরকেও গুলি করা হয়।’

এ বছরের অক্টোবরে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং শ্রমবিষয়ক সাবেক সহকারি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টম মালিনৌস্কি ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, ‘জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী, গণহত্যা হলো একটি আইনি পরিভাষা। জাতিগত নিধন আইনি পরিভাষা নয়। নির্দিষ্ট ধরনের নৃশংসতা বর্ণনা করতে আমরা এ বুলিটি ব্যবহার করি। তাছাড়া, এ ধরনের আখ্যাগুলো (জাতিগত নিধন) অতোটা গুরুতর নয়। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কোন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের আখ্যা (জাতিগত নিধন) কোনও আইনগত বাধ্যবাধকতা বহন করে না।’

প্রতিনিধি পরিষদে প্রস্তাব পাস হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন কংগ্রেস সদস্য স্যান্ডি লেভিন। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে নিন্দনীয় দমন-পীড়ন ও সহিংসতা চালিয়েছে সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। এ প্রস্তাব রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে কথা বলে।’

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা
প্রতিনিধি পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়েছে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কাজ করা মার্কিন সংগঠন বার্মা টাস্ক ফোর্স। তারা বলেছে, ‘প্রতিনিধি পরিষদ এখন আনুষ্ঠানিকভাবে এ অবস্থান নিয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকার ব্যাপক সহিংসতা ও তাদের বাস্তুচ্যুত করার যে নীতি চালাচ্ছে তা গণহত্যা। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছাকাছি এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।’

মার্কিন সিনেটে এ ধরনের একটি প্রস্তাব নিয়ে এরইমধ্যে তৎপরতা চললেও তা এখন পর্যন্ত খুব বেশি একটা এগুতে পারেনি। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষের নেতা মিচ ম্যাককনেলের কারণে তা আটকে আছে। ম্যাককনেলের দাবি, মিয়ানমারের ওপর হস্তক্ষেপ করলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে দেশটি বিচ্যুত হতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসনও প্রতিনিধি পরিষদের পথে হাঁটবে বলে আশা প্রকাশ করেছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসীদের জোট (ফেইথ কোয়ালিশন টু স্টপ জেনোসাইড ইন বার্মা)। সংগঠনটির চেয়ারম্যান মালিক মুজাহিদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি গণহত্যার স্বীকৃতি দেয় তবে তা রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতা নিয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ তৈরি করবে। নাগরিক অধিকারসহ নিজ দেশে তাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে‌ও চাপ তৈরি হবে।’