রাখাইনে আরও উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার দাবি জাতিসংঘের

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরও উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার দাবি করেছে জাতিসংঘ। দুই প্রতিনিধির পাঁচ দিনের রাখাইন সফরেরর অভিজ্ঞতায় দেশটির কর্তৃপক্ষের কাছে এমন আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের দুই সংস্থা। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের ৩৫টি স্থাপনা তৈরির অনুমোদন দেওয়া মিয়ানমার সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তারা। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি এবং দেশটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের সাক্ষাতের পর গত ১৩ ডিসেম্বর ‘স্মল স্কেল কুইক ইমপ্যাক্ট প্রজেক্টস’ নামের এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয় মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ।

12কয়েক প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করে আসলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না মিয়ানমার। গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া এসব রোহিঙ্গাদের ফেরাতে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমার চুক্তি স্বাক্ষর করলেও এখনও শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন। এদিকে রাখাইনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। এমন বাস্তবতায় রাখাইনে বহুদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংবাদমাধ্যমকে প্রবেশ করতে না দিলেও চাপের মুখে এক পর্যায়ে এসে তারা জাতিসংঘকে সীমিত পর্যায়ের প্রবেশাধিকার দেয়।
১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের প্রতিনিধি হিসেবে ৫ দিনের মিয়ানমার সফরে ছিলেন  দুই সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘ প্রতিনিধি দল। দলের সদস্য হাওলিয়াং জু ইউএনডিপি’র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর বের্নার্ড দোলে ইউএনএইচসিআর-এর উপ আঞ্চলিক পরিচালক। রাখাইন সফরকালে তারা স্থানীয়দের সঙ্গে সেখানকার বিদ্যমান নানা চ্যালেঞ্জ এবং অঞ্চলটির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন। 

হাওলিয়াং জু আর বের্নার্ড দোলের রাখাইন সফরকালেই 'কাকতালীয়ভাবে' রাখাইনে জাতিসংঘের এক প্রকল্প অনুমোদন পায়। আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে,  ‘স্মল স্কেল কুইক ইমপ্যাক্ট প্রজেক্টস’ নামের ওই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে তারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থার উন্নয়ন এবং সামাজিক মেলবন্ধনকে উৎসাহিত করতে চায়।

সফর শেষে ইউএনডিপি এবং ইউএনএইচসিআর-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই উপায়ে প্রত্যাবর্তনের শর্ত তৈরির জন্য গত জুনে ওই সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। তবে নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে জাতিসংঘের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শরণার্থীদের বলপূর্বক ফেরত পাঠানোর বিরুদ্ধে সতর্ক বার্তা উচ্চারণ করেছেন। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গারাও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। পাঁচ দিনের এ সফরে জাতিসংঘ প্রতিনিধিরা রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তে ছাড়াও সেখানকার বেশকিছু গ্রাম পরিদর্শন করেন। তবে ফিরে এসে দেওয়া বিবৃতিতে এ সংক্রান্ত কোনও মূল্যায়ন হাজির না করে রাখাইনে আরও উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার চেয়েছে তারা। 

উল্লেখ্য, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র,কখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদ,কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে নাগরিকত্ববিহীন, রাষ্ট্রহীন মানুষে।