চীনে উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার হরণের পক্ষে সাফাই সৌদি যুবরাজের

চীন সফরে দেশটিতে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার হরণের পক্ষে সাফাই গাইলেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বেইজিং সফরকালে ‘সন্ত্রাস ও চরমপন্থা’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চীনের অধিকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন তিনি। এ সময় সন্ত্রাস ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে দুই দেশের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। উল্লেখ্য, উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে ‘সন্ত্রাস ও চরমপন্থা’র বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে বেইজিং।

চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া’র খবরে বলা হয়েছে, সফরে চীন-সৌদি নিষকণ্টক সম্পর্কের ভূয়সী প্রশংসা করেন এমবিএস নামে পরিচিত সৌদি যুবরাজ। আনাদোলু এজেন্সি’র খবরে বলা হয়েছে, চীন ও উইঘুর মুসলিমদের মধ্যে চীনকেই বেছে নিয়েছেন এমবিএস, উইঘুরদের নয়।

চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, উভয় দেশকে চরমপন্থী চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ এবং বিস্তার প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। সমন্বিতভাবে মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরও তাগিদ দেন শি জিনপিং। উত্তরে এমবিএস বলেন, চীনের নিজের নিরাপত্তা রক্ষার অধিকার এবং ‘সন্ত্রাস ও মৌলবাদবিরোধী’ পদক্ষেপের প্রতি সৌদি আরবের সম্মান ও সমর্থন রয়েছে।

সৌদি যুবরাজ বলেন, রিয়াদ বেইজিংয়ের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদারে আগ্রহী।সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় উইঘুর মুসলিমদের বন্দিশিবিরে আটকে রাখার প্রতিবাদে বিক্ষোভ

এদিকে উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার হরণের পক্ষে সৌদি যুবরাজের সাফাইয়ের কঠোর সমালোচনা করেছে যুক্তরাজ্যের মুসলিম কাউন্সিল। কাউন্সিলের মুখপাত্র মিকদাদ ভারসি যুবরাজের বক্তব্যকে ‘ন্যক্কারজনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, এমবিএস উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতন কেন্দ্রে রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

সৌদি যুবরাজের এ সফরের কিছুদিন আগেই চীনের মুসলিম বন্দিশিবিরগুলোতে ১০ লক্ষাধিক উইঘুর মুসলিমকে আটকে রাখার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এগুলো বন্ধের জন্য বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানায় তুরস্ক। ৯ ফেব্রুয়ারি তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উইঘুরদের বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহৃত চীনের এসব বন্দিশিবির মানবতার জন্য ভয়াবহ মাত্রায় লজ্জাজনক।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানও ইতোপূর্বে উইঘুর মুসলিমদের ওপর ‘গণহত্যা’র জন্য চীনকে অভিযুক্ত করেছিলেন। সম্প্রতি চীনের একটি উইঘুর নির্যাতন কেন্দ্রে আবদুরহিম হায়াত নামের একজন খ্যাতনামা উইঘুর সংগীত শিল্পীর মৃত্যুর পর বিষয়টি নিয়ে সরব হয় তুর্কি পররাষ্ট্র দফতর। তবে চীন সফরে বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলার বদলে উল্টো উইঘুরদের ওপর চীনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পক্ষেই সাফাই গান সৌদি যুবরাজ।লন্ডনের চীনা দূতাবাসের সামনে উইঘুর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।

উইঘুর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আট বছরের সাজা ভোগ করছিলেন আবদুরহিম হায়াত নামের ওই শিল্পী। তার মৃত্যুর পর ৯ ফেব্রুয়ারি তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হামি আকসয় বলেন, চীনের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ ১০ লাখেরও বেশি উইঘুরকে আটকে রাখার বিষয়টি এখন আর গোপন কিছু নয়। এসব নিপীড়ন কেন্দ্রে নির্যাতনের মাধ্যমে বন্দিদের মগজধোলাই করা হয়। মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এসব বন্দিশিবির বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে তুরস্ক।

বর্তমানে উইঘুরদের বসবাস চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে হলেও এটি মূলত তুর্কি বংশোদ্ভূত জাতিগোষ্ঠী। তাদের সংস্কৃতিতে আরব ও তুরস্কের প্রভাব রয়েছে। এ জনগোষ্ঠীর বর্ণমালাও আরবি।

তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হামি আকসয় বলেন, চীনে ১০ লাখেরও বেশি উইঘুর তুর্কি নির্বিচারে গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন। নিপীড়ন কেন্দ্র ও কারাগারগুলোতে তাদের নির্যাতন, রাজনৈতিক মগজধোলাইয়ের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে।noname

তিনি বলেন, চীনা কর্তৃপক্ষকে আমরা উইঘুর তুর্কিদের মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানাই। একইসঙ্গে বন্দিশিবিরগুলোও বন্ধের আহ্বান জানচ্ছি।

২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পুনঃশিক্ষাকেন্দ্র নামে পরিচালিত এইসব ভয়াবহ উইঘুর বন্দিশিবিরের কথা অস্বীকার করে আসছিল চীন। অক্টোবরে প্রথমবারের মতো এসবের অস্তিত্ব স্বীকার করে তারা দাবি করতে থাকে, ছোটখাটো অপরাধের জন্য এসব কেন্দ্রে আটক রেখে তাদের বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।

চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুং-এর শাসনামলে দেশটিতে কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধা ও নির্যাতনজনিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। ২০১০ সালে সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টির গোপন নথির সূত্রে একজন বিশেষজ্ঞ ধারণা করেন, মাও সে তুং-এর শাসনামলে অন্তত চার কোটি মানুষ ক্ষুধা ও নির্যাতনের কারণে প্রাণ হারিয়েছে।

২০১৮ সালের আগস্টে জেনেভায় চীনের ওপর জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির দুই দিনের বিশেষ সভায় উঠে আসে চীনে উইঘুরদের বন্দিশিবিরে আটকে রাখার বিষয়টি। সভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির জাতিগত বৈষম্য বিষয়ক সংস্থা জানায়, চীনে ১০ লাখ উইঘুর মুসলিমকে আটকে রাখা হয়েছে। চীনা কর্তৃপক্ষ স্বায়ত্তশাসিত উইঘুর প্রদেশকে কার্যত ‘বিশাল একটি বন্দিশিবিরে’ পরিণত করেছে।

দীর্ঘদিন ধরেই জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে উইঘুরসহ অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের আটকের খবর সামনে আসছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোও জাতিসংঘের কাছে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন দিয়েছে। এসব প্রতিবেদনে উইঘুর মুসলিমদের গণহারে আটকের অভিযোগ তোলা হয় চীনের বিরুদ্ধে।

উইঘুর মুসলিম কারা?

চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ উইঘুর মুসলিম। এই প্রদেশটি তিব্বতের মত স্বশাসিত একটি অঞ্চল। বিদেশি মিডিয়ার ওপর এখানে প্রবেশের ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু গত বেশ কয়েক ধরে বিভিন্ন সূত্রে খবর আসছে যে, সেখানে বসবাসরত উইঘুরসহ ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ব্যাপক হারে আটকের শিকার হচ্ছে।

চীনকে কেন অভিযুক্ত করা হচ্ছে?

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির কাছে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, উইঘুর মুসলিমদের গণহারে ধরে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে নেওয়া হচ্ছে। এরপর সেসব শিবিরে তাদের জোর করে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করা হচ্ছে।

নির্বাসিত উইঘুর মুসলিমদের সংগঠন ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস তাদের এক রিপোর্টে বলেছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই উইঘুরদের আটক করা হচ্ছে। তাদের জোর করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে স্লোগান দিতে বলা হচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস জানিয়েছে, বন্দিদের ঠিকমত খাবার দেওয়া হয় না এবং নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। অধিকাংশ বন্দিকে দীর্ঘদিন আটকে রাখলেও তাদের অভিযুক্ত করা হয় না এবং কোনও আইনি সহায়তা নিতেও দেওয়া হয় না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈশ্বরে বিশ্বাস না করা চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বিদেশি ধর্মীয় প্রভাব নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে। দেশটির কর্তৃপক্ষ এখন ‘সিনিসাইজ রিলিজিওন’ নামে এক প্রচারণা শুরু করেছে যাতে বলা হচ্ছে ‘ধর্মকে যতটা পারো চীনের মতো করে নাও।’ ইতোমধ্যেই সরকারিভাবে উইঘুরদের ঘরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে হান সম্প্রদায়ের ‘গুপ্তচরদের।’ চীনের সরকারি এসব কর্মচারীরা উইঘুর পরিবারের সঙ্গে থাকেন, যাতে তাদেরকে ‘চীনা সংস্কৃতি’র সঙ্গে মানিয়ে নিতে সহায়তা করতে এবং প্রয়োজনে সরকারকে উইঘুরদের ‘অগ্রহণযোগ্য’ জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য দিতে পারেন। আল জাজিরা জানিয়েছে, হান সম্প্রদায়ের ১০ লাখেরও বেশি সরকারি চাকরিজীবীকে উইঘুরদের পরিবারের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরা উইঘুর পরিবারের ‘সদস্য’ হয়ে পরিবারগুলোর ওপর নজরদারি করছে। এর বাইরে সরাসরি বন্দিশিবিরে রয়েছেন আরও বিপুল সংখ্যক উইঘুর মুসলিম। সূত্র: আল জাজিরা, আনাদোলু এজেন্সি, টিআরটি ওয়ার্ল্ড।