বেলুচিস্তান কি পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে? (শেষ পর্ব)

পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবি অনেক পুরনো, অনেকটা ভারত বা পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরের মতোই। পাকিস্তানের এই পিছিয়ে থাকা অঞ্চলটিতে কীভাবে আর কেন স্বাধীনতার চেতনা জন্ম নিল, অতীতে এই আন্দোলন কেমন ছিল, এর ভবিষ্যতই বা কী – তা নিয়ে বিবিসি রেডিও হিন্দি ও উর্দুতে সম্প্রতি একটি সুদীর্ঘ প্রতিবেদন সম্প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো করে পাকিস্তান থেকে বেলুচিস্তান স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে কিনা, প্রতিবেদনে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। বিবিসির মূল রেডিও প্রতিবেদনটির ভাষান্তর করেছেন বাংলা ট্রিবিউনের দিল্লি প্রতিনিধি রঞ্জন বসু। তিন পর্বে তা প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ থাকছে তৃতীয় তথা শেষ পর্ব।noname

২০১৬-তে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে দিল্লির লাল কেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেলুচিস্তানের কথা উল্লেখ করলেন। সারা বিশ্বের বেলুচ নেতারা কিভাবে তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন, উল্লেখ করলেন সে কথা। সেই প্রথম ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী বেলুচিস্তান প্রসঙ্গ প্রকাশ্যে টেনে আনলেন এবং বিশ্বের মনোযোগ সেদিকে আকৃষ্ট হল।

সুইজারল্যান্ড-প্রবাসী বেলুচ নেতা ও প্রয়াত আকবর বুগতির ছেলে ব্রাহামদাগ বুগতির কথায়, ‘ভারত সরকার বেলুচিস্তান নিয়ে এই যে একটা পরিষ্কার অবস্থান ঘোষণা করল, সেটা ছিল দারুণ এক ইতিবাচক পদক্ষেপ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজে বিষয়টি তুললেন আর বিশ্ব জানতে পারল বেলুচিস্তানে কী দুর্বিষহ অবস্থা চলছে।’

ব্রাহামদাগ বুগতি বলেন, ‘পুরো বেলুচিস্তানই একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির কবলে। প্রতিটা শহর ও জনপদে সেনা বা ফ্রন্টিয়ার কোরের সদস্যরা মোতায়েন, বেলুচরা কোনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ালেই তাকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। ফলে বেলুচিস্তানে আজ প্রকাশ্যে কোনও রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালানোই অসম্ভব।’সুইজারল্যান্ড-প্রবাসী বেলুচ নেতা ব্রাহামদাগ বুগতি

লাল কেল্লার ভাষণে নরেন্দ্র মোদি বেলুচিস্তান প্রসঙ্গ টানার পর থেকেই পাকিস্তান দাবি করে আসছে, ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা পাচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ।

সাংবাদিক ও বিশ্লেষক রহিমুল্লা ইউসুফজাই বলেন, ‘পাকিস্তান প্রশাসনের স্পষ্ট অভিযোগ যে বেলুচরা দেশের বাইরে থেকে মদদ পাচ্ছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ থেকে সাহায্য পাওয়ার কথা হয়তো সরাসরি বলা হয় না, তবে ভারত সরকার বা তাদের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর নাম প্রকাশ্যেই করা হয়। নরেন্দ্র মোদি বেলুচিস্তানের কথা প্রকাশ্যে উল্লেখ করার পর এটাও স্পষ্ট যে বেলুচদের নিয়ে ভারতের উৎসাহ বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘তবে কথিত ভারতীয় গোয়েন্দা কুলভূষণ যাদবের গ্রেফতারের পর গোটা বিষয়টাই একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। পাকিস্তান বলছে, ইনি ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মরত কর্মকর্তা। আর ইরানের চাবাহার থেকে বেলুচিস্তানে ঢুকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করতে গিয়ে কুলভূষণ হাতেনাতে ধরা পড়েছেন তিনি। এই ঘটনাকে বেলুচ আন্দোলনে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তার অকাট্য প্রমাণ হিসেবেই পাকিস্তান পেশ করছে।’বেলুচিস্তানে ধরা পড়া কথিত ভারতীয় গুপ্তচর কুলভূষণ যাদব

এর আগে মনমোহন সিং যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, মিসরের শার্ম-আল-শেখে এক শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তান দাবি জানিয়েছিল, কাশ্মিরের মতো বেলুচিস্তান নিয়েও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। সেই দাবি ভারত মেনেও নিয়েছিল।

রহিমুল্লা ইউসুফজাই বলেন, ‘আসলে এটা তো পরিষ্কার, বেলুচদের সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উসকানি তৈরির সুযোগ থাকলে ভারত কেনই বা সেটা নেবে না? ভারতের জায়গায় পাকিস্তান থাকলেও তো সেই একই জিনিস করত!’ 

এই পটভূমিতে এখন প্রশ্ন হল, ‘আজাদ’ বা স্বাধীন বেলুচিস্তান সৃষ্টি হওয়া কি কখনও সম্ভব?

আমেরিকান স্ট্র্যাটেজিক গবেষক স্টিভেন কোহেনের ‘দ্য আইডিয়া অব পাকিস্তান’ বইটি থেকে এখানে উদ্ধৃত করা যাক। স্টিভেন কোহেন বলছেন, ‘বেলুচ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হল তাদের একটি মধ্যপন্থী (মডারেট) ও আধুনিক নেতৃত্বের ভীষণ অভাব রয়েছে।’

‘তা ছাড়া একেই তো বেলুচিস্তানের জনসংখ্যা খুব কম। তার ওপর বেলুচদের এখন সেখানে পশতুনদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যারও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। উপরন্তু ইরান বা আফগানিস্তান থেকেও তারা কোনও সাহায্য পাচ্ছে না।’মার্কিন গবেষক স্টিভেন কোহেনের বই `দ্য আইডিয়া অব পাকিস্তানে`র প্রচ্ছদইরান বা আফগানিস্তানের আশঙ্কা হল, বেলুচ আন্দোলনে মদদ দিলে তাদের দেশের ভেতরেও বেলুচরা বিদ্রোহী হয়ে উঠবে এবং আন্দোলন সেখানেও প্রসার পাবে।

অনেক গবেষকই বিশ্বাস করেন, বেলুচিস্তানে পাকিস্তানি শাসনের বিকল্প কী হতে পারে সেই নকশার ব্লু-প্রিন্ট বেলুচ নেতারা এখনও পেশ করতে পারেননি, আর সেটাও তাদের আন্দোলনের একটা প্রধান দুর্বলতা।

সাবেক ভারতীয় কূটনীতিবিদ বিবেক কাটজু অবশ্য এখানে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলছেন, ‘ইতিহাস বলে ইনসার্জেন্সি যে সব জায়গায় সফল হয়েছে, তার অনেক ক্ষেত্রেই নেশন বিল্ডিং বা রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া তার পরে শুরু হয়েছে। হ্যাঁ, সমস্যা হয়তো কিছুটা হয়েছে – কিন্তু পরে তা উতরেও গেছে।’

কাটজু বলেন, ‘ফলে আগে থেকেই যদি আমরা ধরে নিই বেলুচদের সলিড প্রশাসনিক পরিকল্পনা নেই বলে তাদের আন্দোলন সফল হবে না, সেটা বোধহয় ঠিক হবে না’, বলছেন।

কিন্তু যে বিষয়টা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কোনও ভিন্নমত নেই – তা হল বেলুচ আন্দোলনের নেতৃত্ব বহু ধারায় বিভক্ত, নেতাদের মধ্যে মতবিরোধও তীব্র।সাবেক ভারতীয় কূটনীতিবিদ বিবেক কাটজু

 

রহিমুল্লা ইউসুফজাইয়ের কথায়, ‘বেলুচ নেতাদের কেউ থাকেন যুক্তরাজ্যে, কেউ সুইটজারল্যান্ডে, কেউ আবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে। কেউ কেউ ভারতেও আশ্রয় নিয়েছে বলে শোনা যায়। তবে বেলুচিস্তানে বা পাকিস্তানের ভেতরেও তাদের তেমন কোনও বড় নেতা নেই। এদের কারও সঙ্গে কারও মতের মিল নেই, পথেরও মিল নেই। বড়জোর কয়েকটা ইস্যুতে তাড়াতাড়ি কাছাকাছি আসতে পারেন, কিন্তু বেশির ভাগ ইস্যুতেই পারেন না। ফলে বেলুচদের আন্দোলনে কোনও অভিন্ন প্রোগ্রাম বা কর্মসূচিও তেমন চোখে পড়ে না।’

বস্তুত পাকিস্তান বিষয়ক ঘটনাবলী যে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত ‘ফলো’ করেন তারা প্রায় সবাই একমত – বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার আন্দোলনকে ‘লো কি ইনসার্জেন্সি’ বা কম মাত্রার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পর্যায়েই ফেলতে হবে।  

এই সার্বিক পটভূমিতেই বিবিসির সাংবাদিক রেহান ফজল তিলক দেবেশ্বরের কাছে সরাসরি প্রশ্ন রেখেছিলেন, বেলুচ আন্দোলনের কি তাহলে কখনও সফল হওয়ার আদৌ কোনও সম্ভাবনা আছে?

মি দেবেশ্বরের জবাব, ‘এটুকু বলা যায় সাফল্যের বীজ এই আন্দোলনে নিহিত আছে। কিন্তু তা সফল হতে পারবে কি না তা আসলে দু-তিনটে ফ্যাক্টরের ওপরই নির্ভর করছে।’বেলুচিস্তানের আয়তন পাকিস্তানের মোট ভূখন্ডের প্রায় চুয়াল্লিশ শতাংশ

 

‘প্রথমত, পাকিস্তানের ভেতর একটা ‘ইন্টারনাল ইমপ্লোশন বা অভ্যন্তরীণ ধ্বংস প্রক্রিয়া’ যদি হয়। তাদের অর্থনীতি খুব সঙ্গিন অবস্থায়, যেকোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। জলের সঙ্কটও খুব তীব্র আকার নিয়েছে। ফলে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান যদি খুব দুর্বল হয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে বেলুচ আন্দোলন অবশ্যই আলাদা গতি পাবে।’

‘দ্বিতীয়ত, বেলুচদের জন্য আশার আলো হল তাদের নতুন নেতৃত্ব মধ্যবিত্তদের ভেতর থেকেই উঠে আসছে। শুধু উপজাতীয় (ট্রাইবাল) বেলুচ নেতারা নন, তাদের সমাজের সব শ্রেণী থেকে নেতারা উঠে এসে যদি একটা যৌথ নেতৃত্ব (ইউনিফায়েড কমান্ড) নিশ্চিত করতে পারে সে ক্ষেত্রেও সেটা একটা ঐক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলনের চেহারা নিতে পারে। তবে সেই ঐক্যর জন্ম দিতে হবে বেলুচদের নিজেদেরই।’

‘তৃতীয়ত, হয়তো এমন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল যার প্রভাব হল মারাত্মক। যেমন ধরা যাক, ইরানের প্রতি মার্কিন অবস্থান শেষ পর্যন্ত কী হবে তা এখনও আমরা জানি না – কিন্তু হতেই পারে তাতে হয়তো বেলুচদের বিরাট সুবিধা হয়ে গেল।’

‘ফলে আমি বলব, সম্ভাবনা তো আছেই। বেলুচদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার ভাব প্রবল – আর সেটা মোকাবেলা করতে হলে পাকিস্তানকে সেখানে থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে, তাদের রাষ্ট্রীয় নীতি পুরো পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনা তাতে কোনওদিন রাজি হবে বলে মনে হয় না।’
(শেষ)

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: বেলুচিস্তান কি পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে? (প্রথম পর্ব)

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: বেলুচিস্তান কি পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে? (দ্বিতীয় পর্ব)