ব্রিটিশ নির্বাচনের ‘চমকে দেওয়া’ ফলাফলের নেপথ্যে

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির ভূমিধস জয়ে অনেকেই চমকে গেছেন। জেরেমি করবিনের মতো ‘ভাল মানুষ’ ইমেজের নেতার নেতৃত্বে লেবার পার্টির এমন শোচনীয় পরাজয়ের কারণ খুঁজছেন ভোটাররা। এছাড়া লিবারেল-ডেমোক্র্যাটের দলীয় প্রধান জো সুইন্ডন হেরে গেছেন নিজের আস‌নেই। কেন এমনটি হলো, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল ব্রেক্সিট। এই ব্রেক্সিট নীতিই বড় দুই দলের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

file-20191206-90609-1yvxusy

২০১৬ সালের গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে ব্রিটিশরা ভোট দিলেও এখন পর্যন্ত ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কার্যকর চুক্তি পাস না হওয়ায় বারবার আটকে যায় প্রক্রিয়াটি। ব্রেক্সিট চুক্তি পাস না হওয়ার বড় কারণ পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ পার্টির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা। থেরেসা মে কিংবা বরিস জনসন, যতবারই প্রস্তাব তুলেছেন ততবারই প্রয়োজনীয় সংখ্যক এমপিদের সমর্থন না থাকায় তা আটকে যায় ১ কোটি ৭৪ লাখ মানুষের গণভোটের রায়। 

ব্রেক্সিটের বিরোধিতা করেছিলেন গণভোট আয়োজনের সময় ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ব্রিটিশ জনগণ ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রায় দিলে তিনি পদত্যাগ করেন। অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের আশায় আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন ক্যামেরনের স্থলাভিষিক্ত হওয়া থেরেসা মে। তবে ২০১৭ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি, গঠন হয় থেরেসার নেতৃত্বে জোট সরকার। চুক্তির শর্ত নিয়ে জোট ও বিরোধীদের মত-ভিন্নতার কারণে বিলম্বিত হয় ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন। পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করাতে ব্যর্থ ও দলের নেতাদের আস্থা হারানোর পর পদত্যাগ করেন থেরেসা মে। কনজারভেটিভরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেয় জনসনকে। দায়িত্ব নিয়ে থেরেসা মতোই পার্লামেন্টে নিজের চুক্তি পাস করাতে ব্যর্থ হন তিনি। বাধ্য হয়ে ঘোষণা করেন আগাম নির্বাচন, যাতে করে তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ভোটের ফল শুক্রবার ঘোষণা শুরু হয়। প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী কনজারভেটিভরা পেয়েছে ৩৬৪টি আসন আর লেবার পার্টির জয় ২০৩টিতে। পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে প্রয়োজন হয় ৩২৬টি আসন।

নির্বাচনি প্রচারণা ও ফলাফল বিশ্লেষণে উঠে আসছে যে, ব্রিটিশ জনগণ গণভোটের রায়েরই হয়তো প্রতিফলন দেখতে চেয়েছিলেন। তাই, দ্রুততম সময়ে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের অঙ্গীকার যে দল করেছে, তাকেই এককভাবে ক্ষমতা তুলে দিতে ভোট দিয়েছেন তারা।

২০১৭ সালের নির্বাচনের পথে এবার হাটেননি ব্রিটিশরা। ফলাফলের চিত্রেও তা স্পষ্ট। দলীয় সমর্থকদের পাশাপাশি দোদুল্যমান ভোটও এককভাবে পেয়েছে কনজারভেটিভ পার্টি। অন্যান্য দলের সমর্থক, কিন্তু ব্রেক্সিট প্রশ্নে বিরক্ত, এমন ভোটারদের ভোটও গেছে ক্ষমতাসীনদের বাক্সে। 

 2019-12-06T221312Z_674650084_RC2YPD9ABR2Y_RTRMADP_3_BRITAIN-ELECTION-DEBATE

নির্বাচনে ব্রেক্সিটের পক্ষেই প্রচারণা চালিয়ে গেছে কনজারভেটিভ পার্টি। অন্যদিকে লেবার পার্টি বলেছিল, ব্রেক্সিট নয়, আরেকটি গণভোট আয়োজন করবে তারা। শেষ পর্যন্ত লেবার পার্টিও স্বীকার করেছে এই নীতিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য।

দলের চেয়ারম্যান ইয়ান লাভেরি বলেছেন, ‘আমরা দ্বিতীয় ভোট আয়োজন করতে চেয়েছি। কিন্তু এতে করে আগে ভোট দেওয়া ১ কোটি ৭৪ লাখ মানুষের রায়কে খাটো করা হয়েছে। আপনি যদি গণতন্ত্রকে সম্মান না করেন, তবে আপনার এমনই পরিণতি হবে।’

শুক্রবারের নির্বাচনি ফল অনুসারে, কনজারভেটিভরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। ফলে তাদেরকে আর ঝুলন্ত বা দুর্বল সরকার গঠন করতে হচ্ছে না। ফলে স্পষ্ট, ব্রিটিশরা এবার শক্তিশালী একক সরকার গঠন করতে চেয়েছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের নির্বাচনি ফলাফল বিশ্লেষণেও ব্রেক্সিটকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বরিস জনসন বারবারই ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন। বলার চেষ্টা করেছেন, কেন তা যুক্তরাজ্যের জন্য লাভজনক এবং তার কাছে ভালো এক চুক্তি আছে। এছাড়া এই বিষয়ে লেবার পার্টির অবস্থানের অস্পষ্টতার কথা তারা প্রচারণায় বেশ ভালোমতোই তুলে ধরেছে।

এছাড়া ব্রিটেনকে অনিশ্চিত ‘থ্রি ডব্লিউ’র দেশ বলা হয়। আর এই ডব্লিউয়ের প্রথমটিই হচ্ছে দেশটির আবহাওয়া বা ওয়েদারের ডব্লিউ। বৃহস্পতিবার ভোটের দিন মুষলধারে বৃষ্টি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠে। সকাল থেকে টানা বৃষ্টির কারণে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার হার প্রত্যাশার তুলনায় কম ছিল। 

এদিকে, এবারের নির্বাচনে লেবার পার্টি বড় দুঃসময় পার করলেও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চার নারী টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক, রোশনারা আলী ও আপসানা বেগম জয়ী হয়েছেন। গত নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন তিনজন। অন্যবারের মতো এবারও ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় কোনও বাংলাদেশির ঠাঁই পাওয়ায় হলো না।