ভারতে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে গত কয়েকদিন ধরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের একটি ইসকন হিন্দু মন্দিরে হামলার ভিডিও। দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দু মন্দিরে ‘মুসলিম জিহাদি বাহিনী’র বর্বর আক্রমণের একটি দৃষ্টান্ত এটি – যদিও আসল ঘটনা মোটেও তা নয়।
মূলত বিজেপি, আরএসএস-সহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী দল ও গোষ্ঠীর সমর্থকরাই এই সব ভিডিও ও স্থিরচিত্র সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল করে তুলেছেন। ভারতে যেহেতু নতুন নাগরিকত্ব আইন (যাতে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে) নিয়ে তীব্র বিতর্ক হচ্ছে, তাই বিজেপি সমর্থকরা এই সব ভিডিও/ছবি পোস্ট করে প্রমাণ করতে চাইছেন বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর ধর্মীয় নির্যাতন এখনও অব্যাহত রয়েছে।
তবে নেত্রকোনা ইসকনের টেম্পল প্রেসিডেন্ট জয়রাম দাস বাংলা ট্রিবিউনের নেত্রকোনা প্রতিনিধি হানিফ উল্লাহ আকাশকে জানিয়েছেন, ‘এই হামলাটির চরিত্র আদৌ সাম্প্রদায়িক ছিল না। বরং এই হামলা চালানো হয়েছে একটি দেবোত্তর সম্পত্তির জবরদখল ঠেকানোর জন্য ইসকনের প্রচেষ্টাকে বাধা দিতেই।’
তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘ওই জমি যে ৩৫ জন জবরদখল করে রেখেছেন, তার মধ্যে ২৫ জনই হিন্দু ধর্মাবলম্বী, বাকি জনা দশেক মুসলিম।’ কাজেই এটাকে সাম্প্রদায়িক হামলা না বলে বরং মূলত হিন্দুদের নিজেদের মধ্যে জমি-সংক্রান্ত একটা গণ্ডগোল বলাই ভালো।
তাহলে সেই ঘটনার ভিডিও কীভাবে ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে সহসা ছড়িয়ে পড়লো?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নেত্রকোনার মন্দিরে এই হামলার ঘটনাটি ঘটে গত ১৭ জানুয়ারি। আর সপ্তাহদুয়েক আগে ‘এফএম হিন্দু’ নামে ভারতের দক্ষিণপন্থী হিন্দুদের একটি গ্রুপ ফেসবুকে সেই ঘটনার ভিডিওটি আপলোড করে ক্যাপশন দেয়,‘বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার ইসকন মুক্তারপুর মন্দিরে হামলা চালিয়েছে মুসলিম জিহাদি বাহিনী। তিন জন ভক্ত মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে।’ জগদীশ মুরারি দাস নামে একজন হিন্দু ধর্মপ্রচারকও ফেসবুকে প্রায় একই জিনিস পোস্ট করেন গত ২০ জানুয়ারি।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই একই ভিডিও টুইট করেন চয়ন চ্যাটার্জি, যিনি বিজেপির পূর্বসূরী জনসঙ্ঘর প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পরিবারের সন্তান এবং আশুতোষ মুখার্জির প্রপৌত্র। @সত্যাণ্বেষী টুইটার হ্যান্ডল থেকে তিনি লেখেন, ‘ইসকনের নেত্রকোনা মুক্তারপুর মন্দিরে হামলা চালিয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। তিন জন কৃষ্ণভক্ত গুরুতর আহত। শুধু দেখুন, বাংলাদেশে হিন্দুরা আজও কতটা বিপদের মুখে। ভারতে যারা নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি-র বিরোধিতা করছেন তারা জবাব দিন।’
অবিকল একই রকম বক্তব্য দিয়ে ২৩ জানুয়ারি সেই ভিডিও ও আরও কিছু ছবি টুইট করেন জনৈক অভিজিৎ বসাক, যিনি টুইটার বায়ো-তে নিজের পরিচয় দিয়েছেন বিজেপির যুব শাখা-র তথ্যপ্রযুক্তি সেলের আহ্বায়ক হিসেবে। ‘হিন্দুরা বাংলাদেশে নিরাপদ নয়’ শীর্ষক তার সেই পোস্ট রিটুইট করেছে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি-ও।
ফলে বিজেপি ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর অনুসারীদের মধ্যে এই পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে ঝড়ের বেগে। কিন্তু যে ন্যারেটিভ দিয়ে ঘটনাটি ভারতে প্রচার করা হচ্ছে, আসল বাস্তবতাও কি সেরকম?
মূল হামলাকারী হিসেবে তারা যাদের নাম বলেছে, তারাও বেশির ভাগই হিন্দু– যেমন আলোক সরকার, অজয় বণিক বা স্বপন আইচ। এছাড়াও মোহাম্মদ পরশ নামে একজন মুসলিম হামলাকারীও অবশ্য নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিলেন বলে তাদের অভিযোগ।
ভারতের ‘দ্য কুইন্ট’ পোর্টাল যখন বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে ইসকন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তখনও তারা পরিষ্কার করে জানায়, এই হামলার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মের বিন্দুমাত্র সংস্রব নেই।
ভারতে ‘ফেক নিউজ’ অনুসন্ধানে প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে আহমেদাবাদ-ভিত্তিক অল্ট নিউজ। তাদের সাংবাদিক নিবেদিতা সেনও বিষয়টি নিয়ে বিশদে খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন, ‘যে ঘটনার ভিডিওটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের কোনও সম্পর্ক নেই।’
নিবেদিতা সেন কলকাতা থেকে বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘আমি নেত্রকোনার একজন সুপরিচিত সাংবাদিকের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি, যিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চান না। কিন্তু তিনিও আমাকে নিশ্চিত করেছেন, ঘটনাটি সম্পূর্ণ জমি ও সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত।’
ইসকন কর্তৃপক্ষও বাংলা ট্রিবিউনের কাছে জানিয়েছে, গত প্রায় এক দশক ধরে তারা নেত্রকোনায় আছে ও মন্দির চালাচ্ছে– তবে কখনও তাদের তেমন কোনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মুখে পড়তে হয়নি। ‘শহরের সব ধর্মের মানুষের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো, আমাদের মধ্যে নিয়মিত কুশল বিনিময়ও হয়ে থাকে’, বলেছেন ইসকনের টেম্পল প্রেসিডেন্ট জয়রাম দাস।
কিন্তু, নেত্রকোনার বাস্তবতা যা-ই হোক, সেখানকার একটি অপ্রাসঙ্গিক ঘটনার ভিডিওকে আশ্রয় করেই ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে আজও হিন্দুরা নিরাপদ নন, আর সে কারণেই ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন প্রয়োজন!