কর‌বিনের বিন কি ব্রিটিশ রাজনী‌তিতে সুর তুলতে পারবে

ব্রিটিশ রাজনীতিতে ম্রিয়মাণ বামরাজনীতির ‘নতুন ইতিহাস’ গড়ার লক্ষ্যে মাঠে নেমেছেন প্রবীণ রাজনীতিক জেরেমি কর‌বিন। যার বয়স এখন ৭৬ বছর, মূলত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন‌কে সামনে রেখে তার এই পদক্ষেপ। ঘনিষ্টজনরা বলছেন, পরবর্তী নির্বাচন তার শেষ নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে বলে তিনি মনে করছেন। প্রতিষ্ঠিত দ্বি-ধারার ব্যবস্থাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, যুক্তরাজ্যজুড়ে বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে ব্যাপক সমর্থন নিয়ে ‘নতুন ইতিহাস’ সৃষ্টি করতে চান করবিন। বিশেষভাবে ব্রিটিশ বাংলাদেশি, ব্রিটিশ পাকিস্তানি, ব্রিটিশ ভারতীয় এবং বৃহত্তর ব্রিটিশ দক্ষিণ এশীয় গোষ্ঠী, সেই সঙ্গে মুসলিম এবং ফিলিস্তিনপন্থি কর্মী ও বৃহত্তর বিএএমই সম্প্রদায়কে টার্গেটে নিয়ে কাজ কর‌ছেন তি‌নি।

বাংলা ট্রিবিউন‌ জানতে পেরেছে, বর্তমানে লন্ডনের বিভিন্ন বরোর (স্থানীয় সরকার বা নগর কর্তৃপক্ষ) ব্রিটিশ বাংলাদেশি কাউন্সিলররা, যারা লেবার পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিরক্ত, সেই সঙ্গে ব্রিটিশ বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের কিছু স্বতন্ত্র কাউন্সিলর (যাদের মধ্যে সাবেক লেবার, গ্রিন এবং লিবারেল ডেমোক্র্যাট রাজনীতিকরাও রয়েছেন) এই নতুন দলের টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

এটা সত্য যে, ব্রিটেনের বর্তমান শীর্ষ রাজনীতিকদের মধ্যে করবিনের মতো জনপ্রিয় কোনও নেতা নেই। ব্রিটিশ-বাংলাদেশি, বিশেষ করে ব্রিটেনে দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের সিলেটী সম্প্রদায়ের মধ্যেও তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

দল (এখনও নামহীন) গঠনের বিষয়টি প্রথম নিশ্চিত করেন সাবেক লেবার এমপি জারা সুলতানা। গত ৩ জুলাই জারা ঘোষণা করেন, তিনি, কর‌বিন এবং অন্যান্য স্বতন্ত্র এমপি ও প্রচারকদের সঙ্গে ‘একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠায় সহ-নেতৃত্ব দিতে’ লেবার পার্টি ত্যাগ করছেন। এর পর করবিন দল গড়ার বিষয়‌টি স্বীকার ক‌রে প্রচারণায় নামতে আর দেরি করেননি। ৪ জুলাই সন্ধ্যায় তিনি লেবারের শ্যাডো হেলথ সেক্রেটারি ওয়েস স্ট্রিটিংয়ের নির্বাচনি এলাকা ইলফোর্ড নর্থে একটি জনসভা করেন। সিটি গেটস কনফারেন্স সেন্টারে ‘ব্রেকিং দ্য টু-পার্টি নাইটমেয়ার’ (দ্বি-দলীয় দুঃস্বপ্ন ভাঙা) শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে কর‌বিন ফিলিস্তিনপন্থি স্বতন্ত্র প্রার্থী লিয়েন মোহাম্মদকে নিয়ে ৩০০ জনেরও বেশি লোকের সামনে বক্তব্য রাখেন। লিয়েন মোহাম্মদ জুলাই ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্ট্রিটিংকে মাত্র ৫২৮ ভোটের ব্যবধানে হারাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে কর‌বিন লেবার সরকারের শিশু দারিদ্র্য এবং ইসরায়েল-গাজা সংঘাতের বিষয়ে তাদের অবস্থানের সমালোচনা করেন বলে জানা গেছে। যা অনেক সম্প্রদায়, বিশেষ করে যাদের ফিলিস্তিনপন্থি অনুভূতি প্রবল, তাদের কাছে গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়।

২০২০ সালে ইহুদি-বিদ্বেষ বিতর্কে লেবার পার্টি থেকে বরখাস্ত হওয়া এবং পরবর্তীতে ২০২৪ সালের নি‌জের ইসলিংটন নর্থ নির্বাচনি এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলে দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর করবিনের মাথায় ভাবনাটি আসে। তিনি ২০২৪ সালে ৭ হাজার ২৪৭ ভোটের উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে এই আসনে জয়লাভ করেন, যা ১৯৩৫ সালের পর ইসলিংটন নর্থে প্রথমবারের মতো একজন লেবার এমপি পরাজিত হওয়ার ঘটনা।

কর‌বিন ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যালায়েন্স’ (স্বতন্ত্র জোট) এর সহ-প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন, যা স্বতন্ত্র এমপিদের সংসদীয় উপস্থিতি ও প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীতে বর্তমানে শোকাত আদম (লিসেস্টার সাউথ), আদনান হুসাইন (ব্ল্যাকবার্ন), আইয়ুব খান (বার্মিংহাম পেরি বার) এবং ইকবাল মোহাম্মদ (ডুসবারি ও ব্যাটলি) অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন, যাদের সবাই গত বছর লেবার প্রার্থীদের পরাজিত করেছিলেন।

চার ব্রিটিশ বাংলাদেশি এমপি রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রূপা হক ও আপসানা বেগমের আসনও দখলে নিতে চায় তারা

টার্গেটে বাংলাদেশিরাও

নতুন দলের কৌশলগত লক্ষ্য হলো প্রধান সম্প্রদায়, বিশেষ করে ব্রিটিশ বাংলাদেশি, ব্রিটিশ দক্ষিণ এশীয়, ব্রিটিশ মুসলিম এবং বৃহত্তর বিএএমই ও ফিলিস্তিনপন্থি জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সমর্থন আদায় করা।

নতুন দল ঘোষণার আগে জেরে‌মি করবিনের প‌রিকল্পনা হলো আসন অনুযায়ী কাজ করা, নির্বাচনে প্রার্থী ঠিক করা। সে কাজেই এখন ম‌নো‌যোগী তি‌নি। কারণ তি‌নি ম‌নে ক‌রেন, আগামী নির্বাচনই তার শেষ নির্বাচন। বয়স এখন ৭৬ বছর। তাই জীব‌নের শেষ নির্বাচনে চমক দেখা‌তে চান। গ‌ড়তে চান নতুন ইতিহাস।

দল‌টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন এমন কয়েকজন নেতার কাছ থে‌কে জানা গে‌ছে, নতুন দল‌টি বাংলাদেশি অধ‌্যু‌ষিত টাওয়ার হ‌্যামলেটসের দু‌টি আসনেই আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে চায়। আপসানা বেগ‌মের আসনে তি‌নিই নতুন দল থে‌কে লড়‌ছেন, এটা নি‌শ্চিত। রোশানারা আলীর আসনে বাংলাদেশি বং‌শোদ্ভূত বিতর্কিত নন, অপেক্ষাকৃত প‌রিচ্ছন্ন ব‌্যক্তি ইমেজ আছে এবং জয়ী হ‌তে পার‌বেন এমন কাউকে প্রার্থী করার পরিকল্পনা দল‌টির। টাওয়ার হ্যামলেটস থে‌কে সব নির্বাচন মৌসু‌মে‌ একা‌ধিক প্রার্থী‌কে মা‌ঠে না‌মি‌য়ে পেছ‌ন থেকে খেল‌তে নামা চক্রটিও চায় নতুন দল থে‌কে আসন্ন নির্বাচনে এ আ‌সনে জে‌রেমি করবিনের প্রার্থী যেন তাদের পকেটের কেউ হয়। তবে আগামী বছর মেয়র নির্বাচন থাকায় তারা এখন নিরব। তাদের প‌রিকল্পনা ঠিকঠাক থাকলে রুপা হক ও টিউলিপ সি‌দ্দিকের আসনে শ‌ক্তিশালী প্রার্থী দি‌তে চান কর‌বিন। বৃহত্তর লন্ডনের ম‌ধ্যে অন্তত ৬০টি আসনে শ‌ক্তিশালী প্রার্থী দিতে নতুন প‌রিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দল‌টি। লন্ড‌নের বাইরে বাংলাদেশি অধ‌্যুষিত ওল্ডহাম, নর্দাম্পটন, ম‌্যান‌চেস্টার, কা‌র্ডিফ ও লুট‌নের ক‌য়েকটি আসনে জয়ী হ‌ওয়ার প‌রিকল্পনা করেছে দল‌টি।

দলটির সামগ্রিক নীতিগত লক্ষ্য করবিনের দীর্ঘদিনের নীতিগুলোর ওপর কেন্দ্র করে প্রত্যাশিত দারিদ্র্য মোকাবিলা, অসমতা দূর এবং যুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করা। এই বিষয়গুলো ফিলিস্তিনের প্রতি ধারাবাহিক অবস্থানের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায় এবং ফিলিস্তিনপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সমর্থনকে উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে, যারা লেবারের সাম্প্রতিক অবস্থান নিয়ে ক্রমবর্ধমান হতাশা প্রকাশ করেছে।