৭২ রাষ্ট্রপ্রধানের কর ফাঁকি

মেকি কোম্পানি আর ট্যাক্স হ্যাভেনের কীর্তি

৭২ রাষ্ট্রপ্রধানের কর ফাঁকিমোস্যাক ফনসেকা নামক আইনি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১১ মিলিয়ন নথিপত্র ফাঁস হওয়ার পর সামনে এসেছে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাধরদের অর্থ কেলেঙ্কারির ভয়াবহ তথ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত কিভাবে কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদ গোপন করেন এবং কিভাবে অর্থ পাচার করেন; তা উন্মোচিত হয়েছে নথিগুলো ফাঁস হওয়ার পর। তবে কিভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়? ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় সম্পদ গোপন করে কর ফাঁকি দেওয়া হয়? এই প্রতিবেদনে তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।
ফাঁস হওয়া গোপনীয় এই নথি-পত্রগুলো থেকে দেখা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মোট ৭২ জন বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান নিজেদের দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, লিবিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মুয়াম্মার গাদ্দাফি, বর্তমান সৌদি বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজ এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। এছাড়া, এক ব্যাংকের মাধ্যমে অন্তত প্রায় বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচারের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগীও রয়েছেন। নথিতে বিলিয়ন ডলার পাচারকারী একটি চক্রের সন্ধান মিলেছে, যা পরিচালিত হয় একটি রুশ ব্যাংকের মাধ্যমে এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীও এতে জড়িত বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। স্কাই নিউজের খবরে বলা হয়েছে, ফাঁস হওয়া নথিগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেনকো, ইরাকের সাবেক অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী আয়াদ আলাওয়ি, মিশরের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের ছেলে আলা মুরাবক এবং আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমান্ডার গানলাউগসন রয়েছেন। আর চীনের ক্ষমতাসীন দলের সাবেক ও বর্তমান অন্তত ৮ জনের অবৈধ অথবা গোপন সম্পদ থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে ফাঁস হওয়া নথির মাধ্যমে। এতে ব্রিটিশ রক্ষণশীল এমপি, রাজনীতিবিদের গোপন সম্পদের কথাও রয়েছে।

কিন্তু কিভাবে সম্পদ গোপন করে কর ফাঁকি দেওয়া হয়? এ কাজে পানামার ওই আইনি প্রতিষ্ঠান কী ভূমিকা পালন করে?

মোস্যাক ফনসেকা নামক আইনি প্রতিষ্ঠানটি নির্দিষ্ট ফি নেওয়ার মাধ্যমে মক্কেলদের বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এর মাধ্যমে তারা সম্পদ গোপন এবং কর ফাঁকি দিয়ে ওই অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ উপায়ে ব্যবহারের সুযোগ পান। মোস্যাক ফনসেকাই এসব বেনামি কোম্পানির দেখাশুনা করে থাকে। যদিও ব্রিটিশ আইল্যান্ড, পানামার মতো দেশগুলোতে বৈধ উপায়ে কর ছাড়াই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ার সুযোগ রয়েছে, কিন্তু ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যায়, সেখানে কোম্পানি গঠন করা হচ্ছে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীর পরিচয় এবং অর্থের প্রকৃত উৎস গোপন করার মাধ্যমে। 

একজন বড় শিল্পপতি, যিনি কর ফাঁকি দিতে চাচ্ছেন অথবা একজন আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ী অথবা একজন স্বৈরশাসক ওই পদ্ধতিতে তার অপ্রদর্শিত বা অবৈধ অর্থ বৈধ করে নিতে পারেন। মোস্যাক ফনসেনা তাদের ঘোষণায় জানায় যে, তাদের দেখাশোনা করা কোম্পানিগুলো কর ফাঁকি, অর্থপাচার, সন্ত্রাসী কাজে অর্থ যোগান দেওয়া বা অন্য কোনও বেআইনি কাজে জড়িত নয়।

মেকি কোম্পানি

মেকি কোম্পানিগুলোতে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড এবং লেনদেন দেখানো হয় ঠিকই, কিন্তু এর ভেতরটা থাকে পুরোপুরি ফাঁপা। এ ধরনের কোম্পানি শুধু বিপুল পরিমাণ অর্থের পরিচালনা করে এবং ওই অর্থের প্রকৃত মালিকের পরিচয় লুকিয়ে রাখে। এসব কোম্পানির দেখভাল করার দায়িত্ব থাকে আইনজীবী, হিসাবরক্ষক, এমনকি অফিস কর্মচারীদের হাতে। তাদের নামই লেখা থাকে কোম্পানির কাগজপত্রে। এ জন্য ঘোষিত মজুরি থেকেও কিছু বেশি অর্থ পেয়ে থাকেন তারা। যখন কর্তৃপক্ষ ওই কোম্পানির প্রকৃত মালিকের সন্ধান চালায়, তখন শুধু তারাই সামনে আসেন। অথচ এটা শুধু ওই দুর্নীতির সামনের দিক। প্রকৃতপক্ষে অন্য কেউ দূরে বসে এমনটি করার জন্য তাদের অর্থ যোগাচ্ছেন। যেন তার নামটি কখনও সামনে না আসে।

অফশোর আর্থিক কেন্দ্র

কারও একটি ‘মেকি কোম্পানি’ থাকলে তিনি নিশ্চয় চাইবেন না যে, সেটির প্রধান কার্যালয় লন্ডন বা প্যারিসে হোক। কারণ ব্রিটিশ বা ফরাসি কর্তৃপক্ষ চাইলে ওই কোম্পানির প্রকৃত মালিক থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের পুরো ইতিহাস বের করে ফেলতে পারে। আর সেখানে করও দিতে হয় অনেক বেশি। এ জন্য তাদের দরকার হয় ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’। ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, ম্যাকাও, বাহামাস বা পানামা হলো এমন ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’। যেখানে কোম্পানি গঠনে কর দেওয়ার ঝামেলা নাই, কোম্পানির যেকোনও তথ্য গোপন রাখাটাও পুরোপুরি আইনসিদ্ধ। সেইসঙ্গে সেখানকার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষও অনেক দুর্বল অথবা তাদের অন্ধ করে রাখা হয়।

শেয়ার-বন্ড

ছদ্মনাম ব্যবহার করে বিশাল অংকের অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে শেয়ার এবং বন্ড কেনাটা সহজ সমাধান। এটি নগদ অর্থের মতোই। বাংলাদেশের ৫০০ টাকার একটি নোটে যেমন লেখা থাকে ‘চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’, অর্থাৎ যার হাতে ওই নোটটি রয়েছে, তিনি ওই সমপরিমাণ অর্থ নিজের ইচ্ছেমাফিক খরচ করতে পারবেন। বিয়ারার শেয়ার বা বন্ডও একইভাবে কাজ করে, যার কাছে থাকে, তিনিই তার মালিক।

500

সাধারণত একেকটা বিয়ারার বন্ড পাওয়া যায় ১০ হাজার পাউন্ডে। পানামার কোনও আইনি প্রতিষ্ঠানে ওই বিয়ারার বন্ড পড়ে থাকলে কে তার প্রকৃত মালিক অথবা এমন বন্ড আদৌ কেনা হয়েছে কিনা, সেটিও কেউ বলতে পারবেন না।

উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮২ বসালে বিয়ারার বন্ড বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণটা খুব সহজেই অনুমেয়।

অর্থপাচার

অবৈধ বা অপ্রদর্শিত উপায়ে অর্জিত অর্থ বৈধভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন পড়ে অর্থপাচারের। মাদক ব্যবসায়ী, প্রতারক, কর ফাঁকি দেওয়া ব্যবসায়ী, পেশাজীবী বা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ যখন বিপুল পরিমাণে অর্থ লাভ করে এবং তারা সেই অর্থ খরচ করতে পারছেন না, তখন তারা অর্থপাচারের আশ্রয় নেন। ওই অর্থ অফশোর আর্থিক কেন্দ্রে পাঠানো হয় আর ভুয়া কোম্পানির ‘বৈধ’ বিয়ারার বন্ড কেনা হয়। এভাবে ওই অবৈধ অর্থ বৈধতা পেয়ে আবারও তার প্রকৃত মালিকের হাতে ফিরে আসে।

নিষেধাজ্ঞা ও নিষেধাজ্ঞার বিস্ফোরণ

বিশ্বের বিভিন্ন বিতর্কিত শাসকদের বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ যে পথটি অবলম্বন করা হয় তা হলো—নিষেধাজ্ঞা। এর মধ্যে রয়েছে ‘সামরিক সরঞ্জামাদি কেনা, পণ্য ও তেল রফতানি নিষিদ্ধ করা; স্বৈরশাসক, তার বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন এবং সমর্থকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা।

এসব শাসকদের ওপর যে পরিমাণ আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করা হচ্ছে ওই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে। গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, অস্ত্র বাণিজ্য- যে সমরাস্ত্র ওইসব দেশে চলমান গৃহযুদ্ধের উভয় পক্ষকেই সরবরাহ করা হয় অথবা বিচ্ছিন্ন কোনও শাসককে পরমাণু অস্ত্র দেওয়ার মাধ্যমেও ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় হয়ে থাকে। আর সেখানে লাভের পরিমাণটা রীতিমতো বিস্ময়কর। ওইসব দেশ গোপন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং মেকি কোম্পানিগুলোর আশ্রয় নিয়ে থাকে। এটি বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিরই অংশ হয়ে উঠেছে। দুর্বল শাসন ব্যবস্থায় কর্তৃপক্ষ নিজেদের অন্ধ করে রাখে অথবা তারা চোখ বুজে থাকেন।

ইউরোপিয়ান সেভিংস ডাইরেক্টিভ

আগে কোনও ইংরেজ ব্যক্তি নেদারল্যান্ডসে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুললে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তার কোনও হদিস পেত না। কিন্তু ইউরোপিয়ান সেভিংস ডাইরেক্টিভ (ইএসডি) প্রবর্তনের ফলে এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে কর ফাঁকি দেওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন ইইউভুক্ত দেশগুলোর ব্যাংকে কোনও কর অপরিশোধিত থাকলে তা সরাসরি তদারকি করে থাকে ইএসডি। আর এজন্য অবৈধ অর্থ বৈধ করতে ওই অর্থের ইউরোপীয় মালিকরা ইউরোপের বাইরে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে ভীষণভাবে আগ্রহী। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি-তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪ সালে ইএসডি প্রবর্তনের সময়ে হঠাৎ করেই ইউরোপীয়দের মধ্যে ইউরোপের বাইরে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার হিরিক পড়ে যায়। আর তাদের পছন্দের তালিকায় থাকে পানামা এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো জায়গাগুলো।

পানামা পেপারস:  ধনী ও ক্ষমতাশালীদের ট্যাক্স হ্যাভেন

পানামাভিত্তিক বিশ্বখ্যাত গোপনীয়তা রক্ষাকারী আইনি প্রতিষ্ঠান মোস্যাক ফনসেকা। বিশ্বের ৪২টির বেশি দেশে প্রতিষ্ঠানটির শাখা রয়েছে। এসব শাখায় কর্মরত আছেন ৬০০ কর্মী। সম্প্রতি মোস্যাক ফনসেকা-র সাড়ে ১১ মিলিয়ন গোপন নথি ফাঁস হওয়ার পর দুনিয়াজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ওই নথির সংখ্যা ২০১০ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা নথির চেয়েও বেশি। ২০১৩ সালে সাংবাদিকদের কাছে অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা নথির চেয়েও এ সংখ্যা ঢের বেশি। এসব নথিতে বেরিয়ে এসেছে, বিশ্বের ধনী আর ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কিভাবে কর ফাঁকি দিয়ে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। মোস্যাক ফনসেকা-র অভ্যন্তরীণ ডাটাবেজ থেকে ফাঁস হয়েছে ১১ দশমিক ৫ মিলিয়ন নথি এবং ২ দশমিক ৬ টেরাবাইট তথ্য।

ফাঁস হওয়া নথিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, কিভাবে গোপনীয়তার আড়ালে আইনি প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বনেতাদের অর্থপাচার, নিষেধাজ্ঞা এড়ানো এবং কর ফাঁকিতে সহযোগিতা করেছে। এতে আরও উঠে এসেছে—স্বৈরশাসকসহ বিশ্বের সাবেক ও বর্তমান ৭২ জন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের নিজেদের দেশ থেকে অর্থ লোপাটের ভয়াবহ চিত্র। তবে মোস্যাক ফনসেকার দাবি, কোনওরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তারা গত ৪০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছে।

উল্লেখ্য, প্রায় এক বছর আগে জার্মানির মিউনিখের একটি পত্রিকা জিড্ডয়েশ সাইটুঙ্গ একটি বেনামা সূত্র থেকে এই বিপুল তথ্যভাণ্ডারের সন্ধান পায়। তারা ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস বা আইসিআইজের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি জানায়। তবে নথিগুলোর সংগ্রাহক ও প্রকাশকারীর নাম জানানো হয়নি। সূত্র: বিবিসি।

/এসএ/বিএ/এএইচ/এমএনএইচ/