লিবিয়ায় রাশিয়ার প্রাইভেট বাহিনীর গোপন তৎপরতা ফাঁস

রাশিয়ার একটি গোপন প্রাইভেট বাহিনী লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে কত ধরণের তৎপরতা চালাচ্ছে তা বিবিসির এক নতুন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এই প্রাইভেট বাহিনীর সঙ্গে অনেক যুদ্ধাপরাধ এবং রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কও ফাঁস হয়েছে বিবিসির অনুসন্ধানে।

রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদের এই গোষ্ঠীটির নাম ওয়াগনার গ্রুপ। তাদের একজন যোদ্ধা একটি স্যামসাং ট্যাবলেট ফেলে রেখে গিয়েছিল। এই ট্যাবলেট থেকে পাওয়া তথ্যে লিবিয়ায় গ্রুপটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং তাদের যোদ্ধাদের চিহ্ণিত করা যায় এমন সাংকেতিক নামও ফাঁস হয়ে গেছে।

গ্রুপটি যেসব অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহের চেষ্টা করছিল তার একটি শপিং লিস্ট বা ক্রয় তালিকাও বিবিসির হাতে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এসব সরঞ্জাম একমাত্র রাশিয়ার সামরিক বাহিনীই সরবরাহ করতে পারে। তবে মস্কো ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছে।

ওয়াগনার গ্রুপকে প্রথম চিহ্ণিত করা হয়েছিল ২০১৪ সালে ইউক্রেনে। সেখানে তারা পূর্ব ইউক্রেনে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিচ্ছিল। তবে এর বাইরে সিরিয়া, মোজাম্বিক, সুদান ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকেও তারা বিভিন্ন তৎপরতায় জড়িত ছিল।

২০১৯ সালের এপ্রিলে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের লিবিয়ায় দেখা যায়। সেখানে তারা বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। জেনারেল হাফতারের বাহিনী তখন রাজধানী ত্রিপোলিতে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছিল। ২০২০ সালের অক্টোবরে এক যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাতের অবসান হয়।

ওয়াগনার গ্রুপ কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে তাদের তৎপরতা চালায়। তবে বিবিসি এই গ্রুপের দুই জন সাবেক যোদ্ধার সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে। কোন ধরণের লোকজন এতে যোগ দেয় এবং সেখানে যে কোনও নিয়ম-নীতির বালাই নেই; সেটা তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন। একজন সাবেক যোদ্ধা স্বীকার করেছেন, এই গ্রুপটি বন্দিদের হত্যা করে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তার ভাষায়, ‘একটা বাড়তি মুখের খাবার কে যোগাতে চায়?’

এই অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বিবিসির আরবি ও রাশিয়ান ভাষা বিভাগ যৌথভাবে যে টিভি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে, সেটির নাম, হাফতার'স রাশিয়ান মার্সেনারিজ: ইনসাইড ওয়াগনার গ্রুপ। তাদের অনুসন্ধানে গ্রুপটির সন্দেহজনক যুদ্ধাপরাধ এবং ইচ্ছেকৃতভাবে বেসামরিক মানুষ হত্যার প্রমাণও ফাঁস হয়েছে।

লিবিয়ার একটি গ্রামের একজন মানুষ জানিয়েছেন, তার আত্মীয়দের যখন হত্যা করা হচ্ছিল, তখন কীভাবে তিনি মৃতের ভান করে পড়েছিলেন। তার দেওয়া সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিবিসির টিম একজন সন্দেহভাজন খুনিকে চিহ্ণিত করতে পেরেছে। লিবিয়ার একজন সরকারি সেনা আরেকটি সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, তার এক সহযোদ্ধা এবং বন্ধু ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু তার পেটে দুই বার গুলি করা হয়। এই সৈনিকটি তার ওই বন্ধুকে আর দেখেননি। একই সময়ে নিয়ে যাওয়া আরও তিন সৈনিকের কোন খোঁজও পাওয়া যায়নি।

স্যামসাং কম্পিউটার ট্যাবলেট থেকে ফাঁস হওয়া তথ্যে আরও দেখা যাচ্ছে, এই ভাড়াটে সেনারা লিবিয়ায় বেসামরিক এলাকায় মাইন বা বোমা পোঁতা এবং হত্যার জন্য ফাঁদ পাতার মতো তৎপরতায়ও জড়িত। অথচ কোনও চিহ্ণ না রেখে স্থল মাইন পুঁতে রাখা আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

স্যামসাং ট্যাবলেট থেকে যা ফাঁস হলো

২০২০ সালের বসন্তকালে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধারা দক্ষিণ ত্রিপোলির এলাকা থেকে পিছু হটে। তখন একজন অচেনা ওয়াগনার যোদ্ধা এই স্যামসাং ট্যাবলেটটি সেখানে ফেলে গিয়েছিল। এতে রুশ ভাষায় যুদ্ধক্ষেত্রের কিছু ম্যাপ ছিল। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ওয়াগনার গ্রুপ লিবিয়ার সংঘাতে ভালোভাবেই জড়িত ছিল। তারা সেখানে কী ধরণের তৎপরতা চালাতো সেটারও অনেক ধারণা পাওয়া যায় এসব ম্যাপ থেকে। স্যামসাং ট্যাবলেটটিতে অনেক ড্রোন ফুটেজও পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে অনেক ওয়াগনার যোদ্ধার সাংকেতিক নাম। বিবিসি অন্তত একজন যোদ্ধাকে এই সাংকেতিক নামের ভিত্তিতে চিহ্ণিত করতে পেরেছে। এই ট্যাবলেটটি এখন একটি নিরাপদ স্থানে আছে।

'শপিং লিস্ট'

২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারির ১০ পৃষ্ঠার একটি ডকুমেন্ট বিবিসির হাতে এসেছে। এটি আসলে সামরিক সরঞ্জামের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা। লিবিয়ার একটি গোয়েন্দা সূত্র বিবিসিকে এই তালিকাটি দিয়েছে। এটি সম্ভবত ওয়াগনার গ্রুপের কোনও এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। এই গ্রুপটির অপারেশনে কারা তহবিল যোগাচ্ছে, কারা তাদের সমর্থন দিচ্ছে- দলিলটিতে তার অনেক ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 'সামরিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য' কী কী সরঞ্জাম দরকার, তার তালিকা আছে এতে। এসবের মধ্য ট্যাংক, শত শত কালাশনিকভ রাইফেল এবং অত্যাধুনিক রেডার সিস্টেমের কথা উল্লেখ আছে।

একজন সামরিক বিশ্লেষক বিবিসিকে জানিয়েছেন, এর মধ্যে কিছু সরঞ্জাম কেবল রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব। আরেকজন বিশেষজ্ঞ, যিনি ওয়াগনার গ্রুপের কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন, তিনি বলছেন, এই তালিকা দেখে মনে হয়, এর সঙ্গে দিমিত্রি উতকিনের সম্পর্ক আছে।

দিমিত্রি উতকিন একজন সাবেক রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনিই ওয়াগনার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। রুশ ইন্টেলিজেন্সে কাজ করার সময় তার যে 'কল সাইন' বা ছদ্মনাম ছিল, সেই নামেই ওয়াগনার গ্রুপের নামকরণ করা হয়েছে। বিবিসি দিমিত্রি উতকিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার দিক থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালিকায় 'ইভরো পোলিস' এবং 'জেনারেল ডিরেক্টর' শব্দের ব্যবহার দেখে বোঝা যায়, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ বিশাল ধনী এক ব্যবসায়ী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের সম্পর্ক আছে ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে 'ইভরো পোলিসের' বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারা বলেছিল, এই রুশ কোম্পানিটিকে সিরিয়ার কিছু তেলক্ষেত্র পাহারা দেওয়ার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল। এসব তেলক্ষেত্রের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রিগোঝিনের হাতে। কিছু পশ্চিমা সাংবাদিকও তাদের অনুসন্ধানে ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে প্রিগোঝিনের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। অবশ্য তিনি সব সময় ইভরো পোলিস এবং ওয়াগনারের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেন।

তার একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের সঙ্গে ইভরো পোলিস এবং ওয়াগনারের কোনও সম্পর্ক নেই। মিস্টার প্রিগোঝিন মন্তব্য করেছেন যে, তিনি লিবিয়ায় রাশিয়ানরা কোনও মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, এমন কোন কথা শোনেননি। তার ভাষায়, ‘আমি নিশ্চিত, এটা ডাহা মিথ্যে অভিযোগ।’

রুশ পররাষ্ট্র দফতর বিবিসিকে বলেছে, তারা লিবিয়া সংকটের একটা রাজনৈতিক সমাধান এবং সেখানে যুদ্ধবিরতির জন্য তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে। আর দেশটিতে ওয়াগনারের তৎপরতা সম্পর্কে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা আসলে 'বানানো তথ্য' দিয়ে তৈরি করা। এর আসল উদ্দেশ্য দেশটিকে রাশিয়ার নীতিকে বানচাল করে দেওয়া। সূত্র: বিবিসি বাংলা।