হেগসেথের নির্দেশে ইউক্রেনের অস্ত্র পাঠানো বন্ধ হয়েছিল, জানতো না হোয়াইট হাউজ

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় ইউক্রেনের উদ্দেশে পাঠানো ১১টি অস্ত্রবাহী ফ্লাইট হঠাৎই বাতিল করা হয়। তবে এই সিদ্ধান্তে চমকে যান হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন কমান্ড ট্রান্সকম। ডোভার এয়ার ফোর্স বেস (ডেলাওয়্যার) ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি মার্কিন ঘাঁটি থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল এসব ফ্লাইটের। এগুলোতে ছিল গোলাবারুদ ও অন্যান্য অস্ত্র। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।

৪ মার্চ ট্রাম্প প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে বাইডেন আমলে অনুমোদিত সামরিক সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দেয়। কিন্তু তার আগেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের আদেশে ফ্লাইট বন্ধ হয়েছিল।

ট্রান্সকমের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, এই মৌখিক নির্দেশ এসেছিল হেগসেথের দফতর থেকে। অথচ ৩০ জানুয়ারির যে বৈঠকে এই ইস্যুতে আলোচনা হয়েছিল, সেখানে ট্রাম্প এমন কোনও আদেশ দেননি। বিষয়টি প্রেসিডেন্টের অজানা ছিল বলেও জানিয়েছেন হোয়াইট হাউজের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো।

হোয়াইট হাউজ অবশ্য রয়টার্সকে জানায়, এটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশনার ভিত্তিতে নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত ছিল, যদিও শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কেন এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত ছিলেন না, তার ব্যাখ্যা তারা দেয়নি।

হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান একটি জটিল ও চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিটি আলোচনার বিস্তারিত দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এই যুদ্ধ এখন আগের তুলনায় অনেকটাই শেষের পথে।

ট্রান্সকম-এর হিসাবে বাতিল হওয়া ফ্লাইটগুলোতে প্রায় ২২ লাখ ডলারের ক্ষতি হয়েছে। পরে অবশ্য ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই অস্ত্র পাঠানো পুনরায় শুরু হয়। অথচ পুরো ঘটনাটি শীর্ষ নিরাপত্তা স্তরের কেউই জানতেন না।

তিনটি সূত্র জানায়, হেগসেথ ৩০ জানুয়ারির ওভাল অফিস বৈঠকে একটি নথি নিয়ে হাজির হন, যেখানে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করার পরামর্শ ছিল। বৈঠকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ ও ইউক্রেনবিষয়ক দূত কিথ কেলোগ উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তখনও ট্রাম্প সরাসরি কোনও নির্দেশনা দেননি।

তবে ট্রান্সকম-এর রেকর্ড অনুযায়ী, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশে এই ফ্লাইটগুলো বন্ধ করা হয়েছিল। ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের কর্মকর্তারা ২ ফেব্রুয়ারি থেকেই হোয়াইট হাউজের কাছে প্রশ্ন তোলেন, সহযোগিতা বন্ধের এই আদেশ স্থায়ী, না সাময়িক।

রয়টার্সের অনুসন্ধান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ ও অপেশাদারিত্বের অভিযোগ নতুন নয়। পেন্টাগনের একাধিক বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা জানান, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে।

সিআইএসআইএস-এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও সাবেক মেরিন কর্মকর্তা মার্ক ক্যানসিয়ান বলেন, এই প্রশাসনের মূলনীতি যেন আগে থামাও, পরে ভাবো। প্রযুক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে এটা চলতে পারে, কিন্তু শতবর্ষী প্রতিরক্ষা কাঠামোয় তা বিপর্যয় ডেকে আনবে।

ইউক্রেন সরকার এই অপ্রত্যাশিত স্থগিতাদেশে ক্ষুব্ধ হয়। তারা হোয়াইট হাউজের কাছে একাধিকবার ব্যাখ্যা চাইলেও স্পষ্ট উত্তর পায়নি। পরে হোয়াইট হাউজ এটিকে ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জটিলতা’ বলে ব্যাখ্যা দেয়।

পেন্টাগনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা সহযোগিতা বন্ধ ছিল না, বরং সাময়িক একটি ব্যত্যয় ছিল। তবে ট্রান্সকম, ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের মধ্যে আগে থেকে কোনও সমন্বয় না করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া নজিরবিহীন।

এই ঘটনায় এখন হেগসেথের দফতর এবং উপদেষ্টা দল তদন্তের মুখে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই গোপন তথ্য ফাঁস করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কয়েকজন উপদেষ্টাকে ইতোমধ্যে পেন্টাগন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

যুদ্ধ বন্ধে কেলোগ ও স্টিভ উইটকফ শান্তি আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, কিন্তু পেন্টাগনের একাংশ ইউক্রেনকে সহায়তা বন্ধের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে—এমন বিরোধ অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে সহযোগিতা কিছুটা বন্ধ থাকলেও এখন ট্রাম্প প্রশাসন বাইডেন আমলে অনুমোদিত সামরিক সহায়তা আবার পাঠানো শুরু করেছে। তবে নতুন কোনও নীতির ঘোষণা এখনও আসেনি।