ভারতীয় রাজনীতিতে ‘দেশদ্রোহী ফ্যাক্টর’- এর পুনরুজ্জীবন

ভারতীয় ইতিহাসে বৃহৎ পরিসরে ‘দেশদ্রোহী ফ্যাক্টর’ বলে যা পরিচিত তা হলো, শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষমতালিপ্সু ভারতীয়দের বিদেশি ও দেশি অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলানো। দুঃখের বিষয় হলো, এখনও তা রাজনীতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিরাজ করছে। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ এমন আত্মবিধ্বংসী প্রবণতা উপমহাদেশে নিয়ে আসার জন্য মুঘলদের প্রাথমিকভাবে দায়ী করেন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হলো বাংলার নবাব সিরাজউদদৌলার সঙ্গে তার বিখ্যাত মন্ত্রী মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা, ১৭৫৭ সালে রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলা ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়া। এমনকি মহাশক্তিধর আওরঙ্গজেবও ২০ বছরের চেষ্টায় শিয়া রাজ্য গোলকোন্দা জয় করতে পারেননি ১৬৮৬ সালে স্থানীয় কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ পানিকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত।

1502185941-8594

অবশ্যই এই প্রবণতা মুঘল আসার পরই যে সূচনা হয়েছে তা বলা যাবে না। বাবরের আগমনের আগেই, আফগান শাসক মোহাম্মদ ঘুরি ১১৯২ সালে পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করেন। এর আগের বছর ঘুরি পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু পৃথ্বিরাজ তাকে আফগানিস্তান ফেরত যাওয়ার অনুমতি দেন না ফেরার শর্তে। কিন্তু ১১৯২ সালে পরিস্থিতি বদলে যায় যখন পৃথ্বিরাজের শ্বশুর কানৌজ রাজা জয়চন্দ্র ঘুরিকে সহযোগিতা করেন। পৃথ্বিরাজের ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ ছিলেন জয়চন্দ্র। অনেকেই মনে করেন, জয়চন্দ্রের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভারতকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসকেও হিটলার ও জাপান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার জন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী জওহরলাল নেহরু হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, যদি বোস ব্রিটিশ ভারতে জাপানি সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করেন তবে তিনি তলোয়ার নিয়ে মোকাবিলা করবেন। পরে অবশ্য নেহরু নিজের অবস্থান বদলে ফেলেন। বিশেষ করে স্বাধীন ভারতের জন্য নেতাজিপন্থীদের জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনা করে। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে নেতাজিকে জাপান সমর্থিত দেশদ্রোহী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখন জম্মু-কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা এমপি ড. ফারুক আবদুল্লাহ মৌমাছির বাসায় ঢিল ছুড়েছেন। নিজ রাজ্যের ৩৭০ ধারা ফিরিয়ে আনতে চীনের সহযোগিতা আহ্বান করেছেন তিনি।

গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ওই সিদ্ধান্ত ঘিরে অঞ্চলটিতে নজিরবিহীন নিরাপত্তা নেওয়া হয়। আটক করা হয় শত শত রাজনৈতিক নেতাকে। সাত মাস পর গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান ফারুক আবদুল্লাহ।

২৪ সেপ্টেম্বর একটি নিউজ চ্যানেলে ড. আবদুল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি আশা করছেন চীনের সহযোগিতায় জম্মু-কাশ্মিরের ৩৭০ ধারা ও আগের অবস্থান ফিরে আসবে। একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন। তার নেতৃত্বে ছয়টি রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় গোষ্ঠী জোট বেঁধেছে। তারা ৩৭০ ধারা পুনরায় বহাল রাখতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

ড. আবদুল্লাহ আরও যোগ করেন, কেউ যদি কাশ্মির ভ্রমণ করেন এবং স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করেন তাহলে কাশ্মিরিরা প্রকাশ্যেই ঘোষণা দেবে আমরা ভারতীয় নই। আমরা যদি চীনের সঙ্গে যুক্ত হই তাহলে ভালো হবে।

ক্ষমতাসীন বিজেপি ও জাতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া ছিল প্রত্যাশিত। প্রশাসনিক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তার বিরুদ্ধে পুরনো একটি দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত পুনরায় শুরু করেছে। ইডি’র তদন্ত প্রমাণ করে ক্ষমতাসীন বিজেপি’র বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ। সরকারি তদন্ত সংস্থাকে বিরোধী রাজনীতিকদের হেনস্তা ও চাপে রাখতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশে ড. আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করা হয়েছে।

রাজনৈতিক পর্যায়ে বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র ড. সামবিত পত্র চীনকে নিয়ে আবদুল্লাহর বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও দেশবিরোধী বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতের জন্য এটি দুঃখের ও উদ্বেগের। বিখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর গৌরব আরিয়া টেলিভিশনে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ড. আবদুল্লাহ কেন চীন চলে যাননি? নিজের পরিচয় দিলে সেখানে তিনি গ্রেফতার হতে পারেন।’ চীনের জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীনের আচরণকে ইঙ্গিত করেছেন মেজর গৌরব।

প্রবীণ রাজনীতিক ড. আবদুল্লাহর এই মন্তব্য করার সময়ও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এক হিসেবে দেখলে, তার এই মন্তব্য সাহসিকতাপূর্ণ, রাষ্ট্রদ্রোহী অভিযোগে গ্রেফতার হতে তিনি ভীত নন। তিনি এমন সময় একথা বলেছেন যখন ১৯৬২ সালের পর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছে ইন্দো-ভারত সম্পর্ক। হিমালয় সীমান্তে মুখোমুখি আছে দুই দেশের সেনা। একাধিক সংঘর্ষে প্রাণহানি ও রক্তপাত হয়েছে। কিন্তু উভয় দেশ সতর্কভাবে বড় ধরনের সহিংসতা এড়িয়ে গেছে।

আরেকটু কঠোর ডানপন্থী বিশ্লেষকরা বলছেন, আবদুল্লাহ সচেতনভাবে নিজের শব্দ বাছাই করেছেন। যাতে করে ভারতের জন্য সর্বোচ্চ বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করা যায়। যদি আবার গ্রেফতার হন তাহলে তা জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ অধিকার নয়, নিজের ক্ষয়ে যাওয়া রাজনৈতিক ভাবমূর্তি, সম্মান রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে। ভাগ্য সদয় হলে, রাজ্যের জনগণের কাছে একটি রাজনৈতিক দাবি হয়ে উঠতে পারে। যে জনগণ গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে তেমন কোনও বড় প্রতিবাদ ছাড়া ৩৭০ ধারা বাতিল মেনে নিয়েছেন বলে দৃশ্যমান।

ড. আবদুল্লাহর অবস্থানের একটি ফল হয়তো অনিচ্ছাকৃত: এর ফলে ভারতে সেক্যুলারপন্থী দল ও গোষ্ঠী এবং মিডিয়ার সমর্থন পাওয়া রাজনৈতিকভাবে কঠিন করে তুলেছে। দৃশ্যত তার মন্তব্যের পক্ষে সাফাইয়ের কোনও উপায় নেই। এই মন্তব্য ভারতের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শত্রুকে উন্মুক্ত আহ্বান জানানো ছাড়া আর কিছু নয়। যে দেশের সঙ্গে একটি যুদ্ধের খুব কাছাকাছি ছিল ভারত। তার এই মন্তব্যে বামপন্থী ও সেক্যুলার শক্তির সমর্থনের যে সতর্ক সুযোগ ছিল তা সংকুচিত হয়েছে। তারা হয়তো এখন ন্যাশনাল পার্টির গ্রহণযোগ্যতা ছোট দলের কাছে হারানোর ফলে তার বেপরোয়া ও অনুধাবনযোগ্য হতাশার কথা ইঙ্গিত করতে পারেন। কিন্তু আগেই যেমন বলা হয়েছে, সময়ের কারণে তাকে সমর্থন বা অনুমোদন দেওয়ার মতো অবস্থা খুব কঠিন করে তুলেছে।

বিরোধীদের প্রতিক্রিয়াতে ফাঁকি ও দ্বিধার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস নেতা গুলাম নবী আজাদ থেকে শুরু করে জম্মু-কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম নেই। বিশেষ করে চীন ইস্যুকে বাদ দিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানানো। তারা জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ অধিকার অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার কথাই বলেছেন।

কলকাতার প্রবীণ বামপন্থী বিশ্লেষক চারুব্রত রায় বলেছেন, ‘ড. আবদুল্লাহর বক্তব্য আমি দেখিনি। ফলে তিনি কী বলেছেন তা নিয়ে আমি মন্তব্য করবো না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বিজেপি সরকার কর্তৃক আকস্মিক ৩৭০ ও ৩৫ ধারা রদ করার সিদ্ধান্ত জম্মু-কাশ্মিরের জন্য সহযোগিতা করেনি। যেটি ভারতের নীতিনির্ধারক ড. ভীমরাও আম্বেদকারসহ অনেকেরই দীর্ঘ গুরুতর আলোচনা ও সিদ্ধান্তের ফল। হয়তো কেন্দ্রীয় সরকার দেশে ও বিদেশে যে নেতিবাচক সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে তা হয়তো প্রাপ্য।’ চারুব্রত রায়ের প্রতিক্রিয়াতে অপ্রাসঙ্গিকতা বা অন্যভাবে বললে চীনের কোনও উল্লেখ নেই।

এর তুলনায় ফারুকের ছেলে ও জম্মু-কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ছিলেন অনেক বেশি সতর্ক ও ভারসাম্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, বাবার মন্তব্য ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যা বলা হয়েছে তাতে চরমপন্থামূলক কিছু নেই।

ওমর আরও বলেন, ফারুক তার বক্তব্যে তুলে ধরেছেন কাশ্মিরের সাধারণ জনগণ নিজেদের নাগরিকত্ব নিয়ে যা বলে থাকেন।

হাস্যকর হলেও অতীতে ও সম্প্রতি কলকাতা থেকে কাশ্মির গমনকারী বেশিরভাগই ওমরের মন্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেন।