তুরস্কে ইসলামি দল হিসেবে এরদোয়ানের একেপি’র উত্থান-পতন

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। এই সময়ে অভিজ্ঞ কৌশল ও দৃঢ়তার মাধ্যমে দেশে -বিদেশে তিনি একটি বাস্তববাদী স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু গত ৩১ মার্চের পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল ইঙ্গিত দেয়, দেশে তার এই কৌশলগত বাস্তববাদী নীতি ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে যে সংস্কারপন্থি ইসলামবাদকে পুঁজি করে এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি-একেপি তাকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল; এই নীতি তার সেই ক্ষমতার মতাদর্শগত শিকড়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মার্কিন থিংক ট্যাংক ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউটে উঠে এসেছে একেপির উত্থান পতনের চিত্র।

ইসলামপন্থি সংস্কারবাদী হিসেবে এরদোয়ানের উত্থান

তুরস্কের ইসলামি ঐতিহ্যকে মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০১ সালে রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয় এরদোয়ানের রাজনৈতিক দল একেপি।তবে তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতা ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার নীতিগুলোকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে আসছিল দলটি।

তাই তো প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় এসেই সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীদের হিজাব পরিধানে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এরদোয়ান। সেই সঙ্গে মুসলিম প্রতিবেশী দেশগুলো সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার উদ্যোগ নেন তিনি।

ফলে দেখা যায়, এরদোয়ানের ‘ইসলামি সংস্কারবাদ’ মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্নতির দিকে মনোযোগী ছিল, যা একেপি’র জনপ্রিয়তার মূল কারণ হিসেবে কাজ করে। ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তুরস্কে দারিদ্র্যের হার ৪২% থেকে ১৩.৮০% এ নেমে আসে। একই সময়ে, দেশের সমন্বিত মাথাপিছু জিডিপি ১৪,৮০০ থেকে ২৪,০০০ ডলারে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে তুরস্কের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোন রাজনৈতিক দল হিসেবে একেপি একটানা তিনটি সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

এছাড়া এরদোয়ানের শাসনকালে তুরস্ক সরকার কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন-পিকেকে’র সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করে। যদিও পিকেকে’কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেও আখ্যায়িত করে তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউ। কিন্তু তারপরও কুর্দি সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হিসেবেই ওই শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করে এরদোয়ান। যার ফলও তিনি পান। কারণ এরপর থেকেই কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায় ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের বার্তা দিয়ে, তাদের সমর্থন আদায় করে একেপি। এমনকি এই অঞ্চলের নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও আবির্ভূত হয় দলটি। এর জেরে ২০০৪ সালের স্থানীয় নির্বাচনে কুর্দি অধ্যুষিত এই এলাকায় বেশিরভাগ পৌরসভায় জয়লাভ করে একেপি যার ধারা পরবর্তী নির্বাচনগুলোতেও অব্যাহত ছিল। এর ফলে এই অঞ্চলে পিকেকের সঙ্গে একেপির ক্ষমতার সমবণ্টন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বাস্তবতার দিকে ফেরা

একেপির উত্থান যেমন দ্রুত ছিল; তুরস্কের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তেমনি তাদের পতনও ছিল উল্লেখযোগ্য। কারণ বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তুরস্ক ও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের রাজনীতির গতিশীলতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরদোয়ান পুরোনো জোট ভেঙে দিয়ে নতুন জাতীয়তাবাদী জোট গঠন করেছেন। এ ধরনের কিছু সিদ্ধান্তের কারণেই পরবর্তীতে বড় বড় কিছু পরিবর্তনের ধাক্কা এসে লেগেছে তুরস্কের গায়ে।

২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই তুরস্কে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়, যা একেপির জনপ্রিয়তায় ধাক্কা দেয়। ২০১৩ সালের পর থেকে দেশে দারিদ্র্যের হার আবার বাড়তে শুরু করে। মাথাপিছু জিডিপিও স্থবির হয়ে পড়ে।

এছাড়া আঞ্চলিক অস্থিরতা, বিশেষ করে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং তার ফলে সৃষ্ট শরণার্থী সংকট তুরস্কে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে তুরস্কের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হতে শুরু করে। ২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর, এরদোয়ান আরও কঠোরভাবে বিরোধীদের দমন করতে শুরু করেন। হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয় এবং বিরোধী দলগুলোর উপর দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

এসব কারণে ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে একেপির সমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। সেই সঙ্গে ২০১৯ সালের স্থানীয় নির্বাচনে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহরে মেয়রের পদ হারায় একেপি। এই ঘটনাকে প্রথমবার একেপির পতনের একটি বড় নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে একেপির ওপর থেকে তুর্কি জনগণের আস্থা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, যা এরদোয়ান ও তার দলের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে তোলে।

এছাড়া তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান সুবিধাভোগী ছিল উচ্চ আয়ের শ্রেণিভুক্ত মানুষজন। তাদের সমর্থন প্রধানত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদ থেকে এসেছিল, একেপির আদর্শিক সমর্থন থেকে নয়। এর ফলে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রাকৃত সমর্থক ইসলামপন্থি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। আর সুবিধাভোগীরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছে।

ফল স্বরূপ এই সময়ে সমন্বিত মাথাপিছু জিডিপি এমন অবস্থায় এসে পৌঁছে যা ২০০২ সালের চেয়েও খারাপ। আর দারিদ্র্যের হার ২০২৩ সালে এসে দাঁড়ায় ১৩.৯০% শতাংশে যা আসলে ২০১৪ সালের হার থেকে তেমন পার্থক্য নেই।

ফলে তুরস্কে ইয়েনি রেফাহ পার্টি-ওয়াইআরপি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। বিশেষ করে জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটে পড়া মানুষের হতাশা ও ক্ষোভের সদ্ব্যবহার করে জনপ্রিয় হতে থাকে ওয়াইআরপি।

দেখা যায় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সংস্কারবাদী ইসলামবাদ বৃহত্তর জনগণের মধ্যে আবেদন খুঁজে পেয়েছিল তার অধিক উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। বিপরীতে ওয়াইআরপি এই মুহূর্তে এই ধরনের আবেদন অর্জনের জন্য খুব রক্ষণশীল।

স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে একেপির সংস্কারের পরিকল্পনা চলছে। তবে এরদোয়ানের নতুন জাতীয়তাবাদী এবং লেনদেনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় এই সংস্কারের সফলতা এখনও অনিশ্চিত।