আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি পর্যালোচনা করবে অন্তর্বর্তী সরকার: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

বিদ্যুৎ সরবরাহকারী আদানি পাওয়াসহ ভারতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তার বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এ খবর জানিয়েছে।

২০১৭ সালের একটি চুক্তির অধীনে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে আদানি পাওয়ার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশেষভাবে এই চুক্তির শর্তাবলি এবং বিদ্যুতের মূল্য যৌক্তিক কিনা তা খতিয়ে দেখতে আগ্রহী।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ বলেছেন, ভারতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ করে আদানি গ্রুপের কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হবে। কী ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে; এর শর্তাগুলো কী-এসব নিয়ে। কারণ বিদেশি কোনও কোম্পানি বাংলাদেশের আইন অমান্য করতে পারবে না।

তিনি আরও বলেন, এই তদন্তের মূল লক্ষ্য ভারতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানানো নয়। বরং বাংলাদেশ আসলে আদানি পাওয়ারকে কত টাকা দিচ্ছে, সেটা যৌক্তিক কিনা, সেসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা হবে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি। ছবি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স থেকে নেওয়া।

বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের আদানি গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ার। ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ও আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেড (এপিজেএল)-এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি হয়। ২৫ বছরের জন্য ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) স্বাক্ষর করে তারা। চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিতে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে আদানি পাওয়ার। এখনও সেখান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে ঢাকা।

চুক্তি অনুযায়ী,বাংলাদেশ আদানি গ্রুপের গোড্ডা কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত ১০০ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনবে। এই ইউনিটটি ১০০ শতাংশ আমদানি করা কয়লা দিয়ে চালানো হয়। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে এটি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৩ সালের এপ্রিল-জুন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে এবং বাংলাদেশের মোট বিদ্যুতের ৭-১০ শতাংশ সরবরাহ করা শুরু করে। ২০২৩-২৪ সালে এটি প্রায় ৭ হাজার ৫০৮ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ রফতানি করেছে, যা ভারতের বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ রফতানির প্রায় ৬৩ শতাংশ। মূল্য হিসেবে ভারতের বিদ্যুৎ রফতানি ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা ভারতের বাংলাদেশের কাছে মোট রফতানির প্রায় ১০ শতাংশ।

আদানি পাওয়ারের এক মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশ সরকার আমাদের পিপিএ পর্যালোচনা করছে-এ ধরনের কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা প্রকৃত অংশীদারিত্বের চেতনা নিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছি, যদিও আমাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাওনা রয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি এবং আমাদের পাওনা দ্রুত পরিশোধের জন্য অনুরোধ করেছি। কারণ এটি আমাদের কার্যক্রমকে টেকসই রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বকেয়া নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সতর্ক করেছে আদানি গোষ্ঠী।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ঢাকার মোট বিদ্যুৎ দায় ৩.৭ বিলিয়ন ডলার এবং আদানির ৪৯২ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে। আদানির মোট পাওনা ৮০০ মিলিয়ন ডলার।

এদিকে গত ১২ আগস্ট ভারতের সরকার ২০১৮ সালের একটি আইন সংশোধন করেছে, যা আদানির গোড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো কেন্দ্রগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করতে সহযোগিতা করবে। সংশোধিত আইনে এসব কেন্দ্রকে ভারতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যদি নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎ রফতানি না হয় তাহলে তা ভারতের বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল প্রতি ইউনিটে ৮ টাকা ৭৭ পয়সা। তবে এটি কোম্পানি ভেদে ভিন্ন ছিল। এনভিভিএল লিমিটেডের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের মূল্য ছিল ৪ টাকা ২২ পয়সা থেকে ৮ টাকা ৪৫ পয়সা। পিটিসি ইন্ডিয়া লিমিটেড ৯ টাকা ৫ পয়সা, সেমক্রপ এনার্জি ইন্ডিয়া ৯ টাকা ৯৯ পয়সা এবং আদানি পাওয়ার বা এপিজেএল ১৪ টাকা ২ পয়সা।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে ওই বাংলাদেশি শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা ভারতের সঙ্গে স্থিতিশীল ও নিরপেক্ষ সম্পর্ক চাই। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, কিন্তু শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া একটি বড় সমস্যা। কারণ প্রথমে আমরা দেখেছি তিনি কিছুদিনের জন্য ছিলেন। আর এখন তাকে বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

ড. ইউনূস যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকেও নজর দিচ্ছেন সেই বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেছেন, শেখ হাসিনা প্রশাসনকে নষ্ট করে গেছেন, অর্থনীতি পচে গেছে, দুর্নীতি সর্বত্র। পিয়ন পর্যায়ের লোক কোটি কোটি টাকা বানিয়েছে। আমাদের প্রথমে পুরো ব্যবস্থাকে সচল করতে হবে, এটিকে কাজ করতে দিতে হবে এবং তারপরে এগিয়ে যেতে হবে।