দুনিয়াজুড়ে চরমপন্থীদের উজ্জীবিত করছে ইউক্রেনের যুদ্ধ?

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর ইউরোপে উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বেড়েছে। এসব গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে নব্য নাৎসিবাদীরাও। রুশ আক্রমণ ঠেকাতে ইউক্রেনে লড়ছে নব্য নাৎসিবাদী মিলিশিয়া বাহিনী আজভ ব্যাটালিয়ন। জার্মানি থেকে শুরু করে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে নাৎসি মানসিকতার উগ্রপন্থীদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। জার্মানি থেকে ইউক্রেনে যুদ্ধে আসতে আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ছে। এই যুদ্ধ দুনিয়াজুড়েই চরমপন্থীদের উজ্জীবিত করছে। নব্য নাৎসিবাদী থেকে শুরু করে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদী; কেউই এই তালিকার বাইরে নয়।

যুদ্ধ শুরুর পর জার্মানির একটি নাৎসিবাদী গ্রুপ টেলিগ্রামে লিখেছে, ‘ইউক্রেনের লড়াইয়ের এই সময়ে জাতীয়তাবাদীরা একেবারে পুরোভাগে রয়েছে।’ তাদের প্রচারিত গ্রাফিক্সে দেখা গেছে, দুটি অস্ত্র যেন পরস্পরের সঙ্গে করমর্দন করছে। ফ্রেমে বড় অক্ষরের শিরোনাম, ‘জাতীয়তাবাদীরা জাতীয়তাবাদীদের সাহায্য করে।’

১৯৪৫ সালের পর ইউরোপের বৃহত্তম এই স্থল যুদ্ধ জাতীয়তাবাদী আবেগ, উন্মাদনা আর প্রতিশোধ স্পৃহা সামনে নিয়ে এসেছে। কথিত ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর সময় স্বাধীন ইউক্রেনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে রক্ত ও সংস্কৃতির নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী নীতির কথা বলেন পুতিন। অন্যদিকে রুশ আগ্রাসন মোকাবিলায় অস্ত্র হাতে মাঠে নেমেছে ইউক্রেনের নব্য নাৎসিবাদী ‘আজভ ব্যাটালিয়ন’। কিয়েভের নেতারাও নাৎসি এসএস প্রতীক ব্যবহার করা এই আধাসামরিক গোষ্ঠীটিকে স্বাগত জানিয়েছেন।

ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডের অধীনে কাজ করা এই গোষ্ঠীর সদর দফতর মারিউপোলে। এই শহরেই আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত একটি থিয়েটারে হামলা চালিয়ে তিন শতাধিক মানুষকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে।

চলমান সংঘাতে হিটলারের আদর্শে বিশ্বাসী আজভ ব্যাটালিয়নের মতো গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ, তথা এই সংঘাতের জাতীয়তাবাদী আবেদন অন্যান্য দেশের চরমপন্থীদেরও অনুপ্রাণিত করছে। নব্য নাৎসিবাদী আধাসামরিক গোষ্ঠী থেকে শুরু করে কথিত ইসলামপন্থী জঙ্গিরাও এর বাইরে নয়।

জার্মানির থুরিঙ্গিয়া প্রদেশের গোয়েন্দা প্রধান স্টেফান জে ক্র্যামার। তিনি বলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কারণে এই চরমপন্থীরা অস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহার করে লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ পাচ্ছে।’

জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশটি থেকে ইউক্রেনে যাওয়া অতি ডান উগ্রপন্থীদের সংখ্যা এখনও ন্যূনতম। এখন পর্যন্ত এমন মাত্র ২৭ জন হয় ইউক্রেনে গেছে কিংবা সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এই সপ্তাহেই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশটির আনুমানিক ৩৩ হাজার ৩০০ অতি ডান উগ্রপন্থীদের মধ্যে ১৩ হাজারের মতো সহিংসতার দিকে ঝুঁকছে বলে পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।

ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত জার্মান উগ্রপন্থীদের অংশগ্রহণের কোনও প্রমাণ মেলেনি। তবে গোয়েন্দা কর্মকর্তা স্টেফান জে ক্র্যামারের মতে, অনলাইনের মাধ্যমে এমন মানসিকতার বহু স্বেচ্ছাসেবককে ইউক্রেনের যুদ্ধে অংশ নিতে আকৃষ্ট করা হতে পারে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক মিডল ইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক স্টিভেন স্ট্যালিনস্কি। তিনি বলেন, নব্য নাৎসিবাদী এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের জন্য ইউক্রেন ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানের জিহাদি আন্দোলনের একটি সংস্করণ হয়ে উঠতে পারে। বাস্তবিক সংঘাত তাদের মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেবে। তারা অস্ত্র, হামলার পরিকল্পনা, যোগাযোগ এবং এনক্রিপশনসহ যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এসবে দক্ষতা অর্জন করবে। নিজেদের কর্মকাণ্ডের গোপন অর্থায়নের জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে দক্ষতা আরও উন্নয়নের সুযোগ পাবে।

পুতিন ইউক্রেনে তার আগ্রাসনকে ন্যায্যতা দিতে এই ডিনাজিফিকেশন বা নাৎসিবাদের অবসান ঘটানোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। তবে বাস্তবে জার্মানিসহ অন্যান্য দেশের নব্য নাৎসিবাদীরা যে ইউক্রেনকে একচেটিয়া সমর্থন দিচ্ছে, এমন নয়। বরং এর ঠিক উল্টো চিত্রও রয়েছে।

এই নব্য নাৎসিবাদীদের একাংশ ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াইয়ে সমর্থন দিচ্ছে। অন্য অনেকের আবার পুতিনের কথিত অ্যান্টি আমেরিকান ক্রুসেডের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে, যার লক্ষ্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, যিনি একজন ইহুদি। শুধু নব্য নাৎসিরাই নয় বরং ইসলামি চরমপন্থীসহ সব ধরনের মৌলবাদীরাই যেন ইউক্রেনের এই যুদ্ধকে ঘিরে নিজেদের প্রচারের একটা উপলক্ষ হাতে পেয়েছে।

ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং অনলাইন হয়রানির বিরুদ্ধে জার্মানিতে বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর নিয়ম রয়েছে। তবে গত মাসেই দেশটির সম্প্রচার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ রাশিয়ান সম্প্রচারমাধ্যম আরটি-এর জার্মান ভাষার চ্যানেলটি নিষিদ্ধ করে। বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান সত্ত্বেও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ইস্যুতে দেশটির আলোচিত আজভ ব্যাটালিয়নের প্রশংসাসূচক পোস্ট অনুমোদনের কথা জানিয়েছে।

ইউক্রেন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কেইর জাইলস বলেন, ইউরোপে কোনও প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে হলে রাশিয়া সহজেই তাকে নাৎসি তকমা দিয়ে দেয়। ব্রাজিলের ইউনিকুরিটিবা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু ট্রমান বলেন, ‘ইউক্রেনে নাৎসি ভাবধারা নিয়ে পুতিনের ভাষ্য নিশ্চয়ই আপনি বিশ্বাস করবেন না। তবে দেশটিতে নব্য নাৎসিবাদীদের সংখ্যা যে নগণ্য ব্যাপারটা তাও নয়।’

ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অ্যামি র‍্যানডাল বিবিসিকে বলেছেন, ইউক্রেন নাৎসি বা ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দেশ নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং ফ্যাসিস্টদের উত্থান ঘটেছে। আর এটা পুরো বিশ্বে ঘটছে, ইউক্রেনের একার সমস্যা নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “এই লোকগুলোকে হিরো হিসেবে তুলে ধরা উচিত নয়। তাদের ‘নতুন বাস্তবতা’ হিসেবেও উপস্থাপন করা ঠিক নয়। এগুলো পুতিনকে অজুহাত তৈরি করে দিচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি স্থিতিশীলতাকেও বিপন্ন করে তুলছে।”

দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও বিবিসি অবলম্বনে।