ইউক্রেন যুদ্ধের ‘অনিশ্চিত সমাপ্তি’ নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা

ইউরোপে কি অনন্ত এবং অজেয় একটি যুদ্ধ চলছে? পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর নেতারা এই আশঙ্কা করছেন। একই সময়ে তারা ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান যুদ্ধ তৃতীয় মাসে গড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কোনও পক্ষের নির্ধারক সামরিক বিজয়ের কোনও ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন না। মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-এর এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে।

যুদ্ধ অচলাবস্থার দিকে গড়ানোর ফলে আশঙ্কা বাড়ছে, ইউক্রেন হয়তো প্রাণঘাতী ইউরোপীয় যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে। যা আগামী মাস বা বছরগুলোতে মহাদেশীয় ও বৈশ্বিক অস্থিরতার উৎস হতে পারে।

জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা আশু উদ্বেগ। কিন্তু এখনও করোনাভাইরাস মহামারি থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে থাকা পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে বড় ধরনের সহযোগিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জটিলতা বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকট আরও গভীর করতে পারে। আর রাশিয়া যদি আগ্রাসন সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে বৃহত্তর সংঘাতের ঝুঁকি আরও বাড়বে।

রুশ বাহিনীকে ঠেকাতে ইউক্রেনে মারণাস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির মিত্ররা। তবে বেশিরভাগ বিশ্লেষক বলছেন, কিয়েভকে টিকে থাকতে হলে এই সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে। 

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আক্রমণ জোরদার করার কিংবা অপ্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার অথবা ব্যাপক সেনা সমাবেশের কোনও ইঙ্গিত দেননি বিজয় দিবসের ভাষণে। একই সঙ্গে তিনি পিছিয়ে আসারও কোনও ইঙ্গিত দেননি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও কোনও ছাড় না দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তিনিও চান ২০১৪ সালে বিচ্ছিন্ন হওয়া ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ।

সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র জর্জিয়াতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক ইয়ান কেলি বলেন, এই পর্যায়ে এসে আলোচনায় কীভাবে সমাধান আসবে তা ধারণা করা খুব মুশকিল। ইউক্রেনের পিছু হটার কোনও উপায় নেই। তারা ভাবছে, যুদ্ধে তারা জিতছে।

একই সময়ে কেলি জানান, নিজেদের শক্তির বিষয়ে পুতিনের যতই ভুল হিসাব থাকুক না কেন, তিনি পরাজয় মানবেন না বা সাফল্য দাবি করার আগ পর্যন্ত থামবেন না।

এই মার্কিন কূটনীতিকের মতে, এর বাইরে কিছু পুতিনের কাছে রাজনৈতিক আত্মহত্যার মতোই। কোনও পক্ষই লড়াই থামাতে রাজি না এবং সম্ভবত এই যুদ্ধ আরও কয়েক বছর ধরে চলবে। ইউক্রেন মধ্য ইউরোপে একটি পচা কালশিটে পরিণত হতে পারে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও তার প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, ওয়াশিংটনের লক্ষ্য শুধু ইউক্রেনকে প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা করা নয়, রাশিয়াকে দুর্বল করা। এই পর্যায়ে রাশিয়াকে তারা হুমকি মনে করছেন না।

সোমবার বাইডেন বলেছেন, এই মুহূর্তে পুতিনের কাছে কোনও সমাধান নেই এবং আমি চেষ্টা করছি এই বিষয়ে আমরা কী করতে পারি তা নির্ধারণ করার জন্য।

তাহলে এখন করণীয় কী? এই বিষয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একটি আলোচনায় সমাধানের প্রস্তাব হাজির করেছেন, যাতে রাশিয়া ও ইউক্রেন নিজেদের মুখ রক্ষা করতে পারবে। ম্যাক্রোঁ বলেন, আগামী দিনে আমাদের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এটা কখনও ভুলে গেলে চলবে না। আলোচনার টেবিলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে এটি আমাদের করতে হবে। আলোচনা ও সংলাপের ইতি টানবে ইউক্রেন ও রাশিয়া। কিন্তু অস্বীকৃতি বা একে অপরকে বাদ দিতে এটা করা যাবে না। এমনকি অপমানের মাধ্যমেও এই শান্তি অর্জিত হবে না।

অবশ্য মার্কিন কর্মকর্তারা ম্যাক্রোঁর মতো নিশ্চিত না। তবে তারা মনে করছেন, সংঘাতের ইতি টানার সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের হাতে।

এই সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেন, আমাদের কৌশল হলো ইউক্রেনকে জয়ী হিসেবে আবির্ভূত করা। ইউক্রেন তা আলোচনার টেবিলেও করতে পারে। আমাদের লক্ষ্য হলো আলোচনার টেবিলে ইউক্রেনের অবস্থানকে শক্তিশালী করা। একই সঙ্গে আমরা রাশিয়াকে চড়া মূল্য দিতে বাধ্য করছি।

কিন্তু ইউক্রেনকে জয়ী হিসেবে হাজির করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা ইউরোপীয় রাজধানীগুলোর কর্মকর্তাদের মনে উদ্বেগ তৈরি করছে। বিশেষ করে বাল্টিক রাষ্ট্র- এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়ার। এই দেশগুলোর রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে এবং তারা ন্যাটোর সদস্য। স্বাভাবিকভাবে তারা রাশিয়ার ভবিষ্যৎ অভিপ্রায় নিয়ে উদ্বিগ্ন।

বাল্টিক দেশ ও পূর্ব ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্যদের জন্য হুমকি বাস্তব এবং সোভিয়েত দখল ও শাসনের স্মৃতি এখনও পুরনো হয়নি। তারা বলছেন, ইউক্রেনে রাশিয়াকে ছাড় দিলে পুতিন আরও পশ্চিম দিকে অগ্রসর হবেন।

লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েলিয়াস ল্যান্ডসবার্গিস সোমবার বলেছেন, সত্যি কথা বলতে, আমরা এখনও যুদ্ধের শেষ নিয়ে ভাবছি না। ইউক্রেনে ভূখণ্ডগত ছাড় দিলে আইনের শাসনের বদলে জঙ্গল শাসিত ব্যবস্থা তৈরি হবে।

তিনি পরামর্শ দিয়েছেন পশ্চিমা দেশগুলোকে জয় কেমন হবে তা সম্পর্কে অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য। তার কথায়, আমরা কখন প্রকৃত জয় বিবেচনা করব? কেমন পরিস্থিতি আমরা দেখতে চাই?