সুইডেন, ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদান রাশিয়ার ‘পরাজয়’?

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি নিরাপত্তা বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছেন।

ফেব্রুয়ারিতে তিনি বলেছিলেন, ইউক্রেনে তার দেশ বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে পূর্ব ইউরোপ ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশগুলোতে ন্যাটোর ‘অবিরাম’ সম্প্রসারণ ঠেকাতে। 

রাশিয়ার আক্রমণের ফলে বাস্তবে তা-ই ঘটতে শুরু করেছে। 

ফিনল্যান্ড ও সুইডেন জানিয়েছে, তারা পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগদান করতে চায়। সদস্য হওয়ার এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে প্রায় এক বছর সময় লাগতে পারে। 

জোটে তারা যোগ দেওয়ার পর ন্যাটোর সেনারা ফিনিশ-রুশ সীমান্তে হাজির হতে পারে। যে সীমান্ত ১ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ।

শীতল যুদ্ধের সময় ১৯৪৯ সালে ন্যাটো প্রতিষ্ঠার সময় জোটটির সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১২টি রাষ্ট্র।  

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তিনটি সাবেক সোভিয়েত দেশসহ পূর্ব ইউরোপের ১১টি রাষ্ট্র জোটটিতে যোগদান করে।

ন্যাটোর এই সম্প্রসারণকে ক্রেমলিন নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে এবং এর ইতি টানার আহ্বান জানিয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আক্রমণের আগে পশ্চিমাদের কাছে পুতিন যেসব দাবি তুলেছিলেন, এটিই ছিল সেগুলোর মূলে।

ফলে, স্টকহোম ও হেলসিঙ্কির ন্যাটোতে যোগদানের ঘোষণা দেশে ও বিদেশে পুতিনের খ্যাতির জন্য জোড়া আঘাত।

রাশিয়া থেকে পালানো বিরোধী দলীয় অ্যাক্টিভিস্ট সের্গেই বিজিউকিন বলেন, এতে দুটি ক্ষেত্রে পুতিনের পরাজয় হয়েছে- বিদেশ ও দেশে।

মাত্র কয়েক বছর আগেও কিছু রাজনৈতিক শক্তি ন্যাটোকে শীতল যুদ্ধের অবশেষ হিসেবে বিবেচনা করত।

কিন্তু এখন আর তা মনে করা হয় না, কারণ পুতিন-বান্ধব হাঙ্গেরি ও সার্বিয়া ছাড়া ইউরোপ রাশিয়ার নতুন দৃঢ়তার বিপদ বুঝতে পেরেছে। অনেকে এটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা হিসেবেও মনে করেন।

ইউরোপে ন্যাটো। সূত্র: আল-জাজিরা

রাশিয়ায় কট্টর ক্রেমলিনপন্থীরা রাষ্ট্রীয় অনুমোদিত টেলিভিশন নেটওয়ার্কে ব্যাখ্যা করতে জটিলতায় পড়ছেন যে, পুতিনের ভয়াবহ নিরাপত্তা দুঃস্বপ্ন কীভাবে বাস্তবে পরিণত হচ্ছে।

কিছু রুশ নাগরিক ইতোমধ্যে ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামো বদলে দেওয়ার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছেন। পরিস্থিতি তুলে ধরতে তারা হাস্যরত ব্যবহার করছেন।

সেন্ট পিটার্সবুগের এক রেস্তোরাঁ শেফ শুধু নিজের শেষ নাম জানিয়ে ব্যঙ্গাত্মক-ভাবে বলেন, সবকিছু মিলিয়ে আমি আবারও ভাবছি পুতিন একজন জার্মান স্পাই। রাশিয়াকে ধ্বংস করতে তার চেয়ে বেশি কেউ করেনি এবং ন্যাটোকে আমাদের দরজার সামনে নিয়ে আসেনি। 

ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের প্রতিবেশী দেশের মানুষেরাও মনে করছেন, দুই দেশের ন্যাটোতে যোগদান বোধগম্য ও বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত। বিশেষ করে পুতিন যখন অনুমানযোগ্য নন। 

নরওয়ের মানবাধিকার সংস্থা হেলসিঙ্কি কমিটি’র সিনিয়র পলিসি উপদেষ্টা ইভার ডেল মনে করেন, দেশ দুটি পুরনো শত্রুর কাছ থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করছে মাত্র। তিনি বলেন, ইউক্রেনে আক্রমণের পর পুতিনের আশ্বাসের কোনও মূল্য নেই। পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা বলা হয়ত কিছু সময়ের জন্য কৌশলগত-ভাবে কাজে লেগেছে, কিন্তু এটি ফিরে এসেছে। আন্তর্জাতিকভাবে রাশিয়ার অবস্থান একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে।

তিন শতক আগে পিটার দ্য গ্রেট প্রথম রুশ জার সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়েছিল সুইডেনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২১ বছরের যুদ্ধে জয়লাভের পর।

এই জয় রাশিয়াকে পূর্ণাঙ্গ ইউরোপীয় শক্তিতে পরিণত করে। পিটার তার নতুন রাজধানী গড়ে তুলেন বাল্টিক সাগরের তীরে সেন্ট পিটার্সবুগে।

ওই যুদ্ধের পর থেকে কোনও যুদ্ধে জড়ায়নি সুইডেন। নীতিগতভাবে দেশটি যেকোনও সামরিক ও কূটনৈতিক জোটের বাইরে ছিল।

এক শতক পরে সুইডেনের কাছ থেকে ফিনল্যান্ড দখল করে রাশিয়া।

১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় ফিনল্যান্ড। সোভিয়েত স্বৈরশাসক জোসেফ স্ট্যালিন সাবেক রুশ ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলে তার সঙ্গে ১৯৩৯-৪০ সাল পর্যন্ত রক্তাক্ত উইন্টার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ফিনল্যান্ড।

কমিউনিস্ট মস্কোর জন্য যুদ্ধটি এত অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়কর ছিল যে, এর ফলে ১৯৪১ সালে নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের সোভিয়েত আক্রমণের পথ সুগম করে।

শীতল যুদ্ধের সময় নরডিক দেশ দুটি রাশিয়াকে কোনও উসকানি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ন্যাটোতে বারবার যোগদানের প্রস্তাবের পরও জোট-নিরপেক্ষ অবস্থানে অটল থাকে।

কিন্তু সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের জন্য ন্যাটোতে যোগদান একেবারে নতুন কিছু হবে না। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর সদস্য এবং ন্যাটোর শান্তি কর্মসূচির অংশীদার।

২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখলে পর ন্যাটোর সঙ্গে সহযোগিতা গভীর করতে শুরু করে দেশ দুটি এবং এবার পুতিনের আক্রমণ তাদেরকে পূর্ণ সদস্য হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

‘ঐতিহাসিক পরিবর্তন’

স্টকহোম-ভিত্তিক একটি থিংক-ট্যাংক সুইডিশ ডিফেন্স রিসার্চ এজেন্সির ডেপুটি গবেষণা পরিচালক এভা হ্যাগস্ট্রম ফ্রিসেল বলেন, এই আক্রমণ সুইডেনের নাগরিক ও রাজনীতিকদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, ন্যাটোর সদস্য ও ঘনিষ্ঠ অংশীদারের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।

তার মতে, প্রায়োগিক জোট-নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া সুইডেনের জন্য ন্যাটোর সদস্য হওয়া একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন। বলেন, এতে সুইডেনের প্রচলিত জোট-নিরপেক্ষ নিরাপত্তা নীতির ঐতিহাসিক পরিবর্তন এবং একই সময়ে গত ত্রিশ বছর ধরে যে নীতি ও সংহতির ধারা ছিল তা অব্যাহত রাখা।  

নতুন যুগের যখন সূচনা হতে যাচ্ছে তখন দেশ দুটি ন্যাটোর সদস্য হতে চাইছে।

রবিবার ফিনিশ প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তো বলেছেন, একটি সুরক্ষিত ফিনল্যান্ডের জন্ম হয়েছে একটি স্থিতিশীল, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল নরডিক অঞ্চলের অংশ হিসেবে।

এর কয়েক ঘণ্টা পর সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা অ্যান্ডারসন বলেছেন, সুইডেন ও সুইডিশ জনগণের সুরক্ষার জন্য ভালো হলো ন্যাটোতে যোগদান। আমরা মনে করি সুইডেনের আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা প্রয়োজন। ন্যাটোতে যোগদানে যা পাওয়া যাবে।

আর ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, দেশ দুটির জোটে যোগদান প্রমাণ করবে ‘আগ্রাসন কাজে আসে না’। 

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা অবলম্বনে।