দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ

রাশিয়ার ভেতরে হামলা ইউক্রেনের ‘কৌশলগত মুন্সিয়ানা’

রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে সম্প্রতি ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছেন ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা। সোমবার সকালে রাশিয়ার দুটি বিমানঘাঁটিতে রহস্যময় বিস্ফোরণ ঘটেছে। এই বিস্ফোরণের পর একটি নতুন ও অপ্রত্যাশিত অস্ত্র হাজির হয়েছে। হয়ত দূরপাল্লার রকেট কিংবা পরিবর্তিত একটি ড্রোন।

যুদ্ধের রণক্ষেত্রে বহুদূরে এই দুটি বিস্ফোরণ ঘটেছে। রুশ সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশিত ভিডিওতে সারাতভ অঞ্চলে রাশিয়ার বিমানঘাঁটি অ্যাঙ্গেলস-২ তে বিস্ফোরণ দেখা গেছে। অপর বিস্ফোরণ ঘটেছে রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন ও রাজধানী মস্কো থেকে মাত্র ১৫০ মাইল দূরে রিয়াজান অঞ্চলের কাছে দিয়াজিলেভো সামরিক বিমানঘাঁটিতে।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, দুটি ঘাঁটিতে অন্তত তিনজন নিহত ও অপর পাঁচজন আহত হয়েছে। জ্বালানিভর্তি একটি ট্রাকে বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায়। অন্তত দুটি উড়োজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ এখনও স্পষ্ট। কিন্তু দৃশ্যত মনে হচ্ছে ইউক্রেন রাশিয়ার দূরপাল্লার যুদ্ধবিমান টিইউ-৯৫ ও টিইউ-২২এমকে আঘাতের একটি উপায় বের করে ফেলছে। দুটি বিমানঘাঁটিতে এসব যুদ্ধবিমান রাখা ছিল। অক্টোবর থেকে ক্রেমলিন এই দুই ধরনের কৌশলগত বোমারু দিয়ে ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোকে তছনছ করে দিয়েছে একের পর এক হামলায়। এর ফলে শীতে লাখো ইউক্রেনীয় বিদ্যুৎ ও হিটিং ব্যবস্থা ছাড়াই দিনযাপান করছেন।

জল্পনা রয়েছে, কিয়েভ এক ধরনের বিশেষ আক্রমণের ড্রোন উদ্ভাবন করেছে যেটি ১ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে পারে। নভেম্বরের শেষ দিকে ইউক্রেনের এক সেনা বলেছিলেন, ইতোমধ্যে এই অস্ত্রটি রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। যদি এই দাবি সঠিক হয় তাহলে রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশ ইউক্রেনের নিশানার আওতায় রয়েছে। এত দিন নিশানার বাইরে থাকার সুবিধা পাচ্ছিল রাশিয়া। দেশটি নিজেদের ভূখণ্ডের ভেতর থেকে দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনীয় স্থাপনায় নিক্ষেপ করতে পারছিল। এবার তা হুমকির মুখে পড়বে।

ইউক্রেনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রি জাগোরোদনিয়ুক বলেছেন, রাশিয়ার যেখানে দুর্বল আমরা সেখানে আঘাত করছি। আমরা যেখানে শক্তিশালী সেটি রক্ষা করছি।

ইউক্রেনীয় সমর কৌশলকে সুযোগ সন্ধানী হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। তার কথায়, রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ডনবাস অঞ্চলে বাখমুত শহর দখলের লক্ষ্যে সর্বাত্মক অনির্দিষ্ট হামলা চালাচ্ছে। যদিও তারা ব্যাপক সেনা ও সরঞ্জাম হারিয়েছে।

শীতকালে আগামী কয়েক মাস ইউক্রেনযুদ্ধ মোটামুটি একই থাকবে বলে মনে করছেন বেশিরভাগ সামরিক বিশেষজ্ঞ। শীতের আগে ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণে খারকিভের বেশিরভাগ এলাকা পুনরুদ্ধার করেছে এবং খেরসন শহর মুক্ত করেছে। বসন্তের আগে ইউক্রেন আরও পাল্টা হামলা চালাতে পারে মনে করছেন আন্দ্রি জাগোরোদনিয়ুক।

সর্বশেষ সোমবারের গেরিলা ধাঁচে হামলা দেখিয়ে দিয়েছে শত্রুপক্ষ রাশিয়ার চেয়ে ইউক্রেনের কৌশলগত মুন্সিয়ানা। আর নিয়মিত অবাক করার সামর্থ্য জারি রাখছে কিয়েভ। অক্টোবরের শেষ দিকে কৃষ্ণ সাগরে ক্রিমিয়া বন্দরে রুশ নৌ বহরে হামলা চালায় ইউক্রেন। ফ্ল্যাগশিপ যুদ্ধজাহাজ অ্যাডমিরাল মাকারোভসহ বেশ কয়েকটি রুশ ফ্রিগেট অচল হয়েছিল বলে খবর পাওয়া গেছে।

নৌবাহিনীর বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা মনে করেন ইউক্রেন একটি প্রাণঘাতী ও চতুর সামুদ্রিক ড্রোন উদ্ভাবন করেছে। এতে জেট-স্কির যন্ত্রাংশ এবং রিমোট নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরা রয়েছে। যা দিয়ে কমান্ড সেন্টার থেকে হামলাস্থলের অবস্থা সরাসরি চাক্ষুষ করা যায়। এর সম্মুখভাগে বিস্ফোরক বসানো যায়। আগস্টে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার সাকি বিমানঘাঁটিতে হামলাতেও ইউক্রেনীয় ড্রোনের ভূমিকা ছিল। ওই হামলায় রাশিয়ার ৯টি যুদ্ধবিমান বিস্ফোরিত হয়।

পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, এমন ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক অভিযানের আগে বেশিরভাগ সময় কিয়েভ মিত্রদের অবহিত করে না। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটি করে। তারা মনে করে, হামলার আগে পরিকল্পনা জানালে হয়ত অভিযান পরিচালনা থেকে তাদের বিরত রাখা হবে। অতীতে চাপের মুখে কিছু নির্দিষ্ট আক্রমণ বাদ দিতে হয়েছিল। রাশিয়ার ভেতরে হামলা স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোর একটি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত এবং আতঙ্কের পারমাণবিক উত্তেজনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ক্রেমলিন তো দাবি করে বসেছে, তারা ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে–ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পুতুল সরকার মনে করে রাশিয়া। রুশ আক্রমণের পর কিয়েভকে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কোনও দূরপাল্লার অস্ত্র দেয়নি যা দিয়ে রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালাতে পারবে ইউক্রেন।

যুক্তরাষ্ট্র দূরপাল্লার অস্ত্র না দিলেও ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকার বিশেষ অভিযানের জন্য নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। এগুলোর মধ্যে অক্টোবরে দখলকৃত ক্রিমিয়ায় কার্চ সেতুতে হামলা রয়েছে। এর আগে এপ্রিলে রাশিয়ার ফ্ল্যাগশিপ যুদ্ধজাহাজ মস্কোভাকে ডুবিয়ে দেওয়া হয় ইউক্রেনীয় জাহাজবিধ্বংসী নেপচুন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে। এসব হামলায় রাশিয়ার মর্যাদা খর্ব হয়েছে। আগামীতে আরও এমন অবাক করার মতো হামলা চালাতে পারে ইউক্রেন।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান