যুদ্ধ শেষের শুরু, আশার আলো দেখছেন ইউক্রেনীয় সেনারা?

পূর্ব ইউক্রেনের পোক্রোভস্ক শহরের উপকণ্ঠে ড্রোন থেকে পাঠানো লাইভ ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার বিশাল কুণ্ডলী। ইউক্রেনীয় কামান গোলাবর্ষণ করছে রুশ অবস্থানে, যেখানে কিছুক্ষণ আগেই কয়েকজন রুশ সেনার গতিবিধি দেখা গিয়েছিল।

একজন রুশ সেনা গুরুতর আহত বা নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সংবাদকর্মীরা তখন ইউক্রেনের ১৫৫তম যান্ত্রিক ব্রিগেডের একটি অস্থায়ী কমান্ড সেন্টারে। এটি স্থানীয় একটি বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে।

ফ্রন্টলাইনে গোলাবর্ষণের পজিশন থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে থাকা এ ঘরে চোখ আটকে যায় একেকটি স্ক্রিনে, যেখানে ভেসে উঠছে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির চিত্র—ছয় মাস আগেও যা এতটা ভয়াবহ ছিল না।

এই কয়েক মাসে পোক্রোভস্ক রক্ষায় ইউক্রেনীয় সেনাদের তীব্র লড়াইয়েরই প্রমাণ যেন এসব ধ্বংসস্তূপ। এই শহরটি ডনেস্ক অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন কেন্দ্র।

এমন কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও এই সপ্তাহে সেনাদের মধ্যে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, তুরস্কসহ আন্তর্জাতিক মহলের উদ্যোগে প্রায় তিন বছর পর রাশিয়া ও ইউক্রেন সরাসরি শান্তি আলোচনায় বসতে রাজি হওয়ায় এমন আশার জন্ম নিয়েছে।

রণক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় সেনাদের একাংশ। ছবি: বিবিসি

১৫৫তম ব্রিগেডের একজন কর্মকর্তা, যার ছদ্মনাম কোজাক, তিনি বলেন, আমার মনে হয় কিছু একটা হতে চলেছে। রাশিয়া প্রথমবারের মতো এই আলোচনা চেয়েছে, এটা উল্লেখযোগ্য। ২০২২ সালের পর তারা তো কোনও যোগাযোগেই আসেনি।

তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার পেছনের ঘাঁটি ও সরবরাহ পথ আমরা ধ্বংস করেছি। আগের মতো শক্তিশালী নয় ওরা। কিছু একটা হবেই।

৩৭ বছর বয়সী ইউরিই, যিনি যুদ্ধ শুরুর আগে একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিনি বলেন, এই যুদ্ধ শেষ হোক—এটাই চাই। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যুদ্ধ শুরু করিনি, তাই থামানোর দায়ও আমাদের না।

তারা যখন কথা বলছিলেন, তখনই আবার স্ক্রিনে দেখা গেলো রুশ সেনারা নড়াচড়া করছে। তাদের অবস্থান চিহ্নিত করে দ্রুত তা কামান ইউনিটে পাঠানো হয়।

আমরা গাড়িতে করে রওনা হই কামানের অবস্থানস্থলে, কাদামাটির পথ ধরে। গাড়ি যেন উড়ে চলে, কারণ শত্রুপক্ষের ড্রোন থেকে বাঁচতে যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছাতে হয়।

সেখানে পৌঁছে বিবিসির সংবাদকর্মীরা দেখতে পান, ফরাসি তৈরি সেলফ-প্রোপেল্ড কামান ‘সিজার’ প্রস্তুত। কোজাক বলেন, এই কামান খুব দ্রুত কাজে লাগানো যায় এবং নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ করে। এটা অনেক বেশি কার্যকর, পুরোনো সোভিয়েত যুগের অস্ত্রের চেয়ে।

চার রাউন্ড গোলাবর্ষণ করা হয়। আশপাশে শোনা যায় শত্রুপক্ষের পাল্টা কামানের শব্দ। কোজাক বলেন, শত্রুর একের পর এক আক্রমণ ঠেকাতে প্রচুর গোলাবারুদ দরকার। আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুদের কাছে আরও সাহায্য চাই।

যখন সেনাদের প্রশ্ন করা হয় যে ইউক্রেন কি ভূমি ছেড়ে দিয়ে শান্তির পথে যাবে—তখন তাদের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট।

ইউরি বলেন, আমার আট বছরের মেয়ে আছে, আমি বাড়ি ফিরতে চাই। কিন্তু কিছু এলাকা ছেড়ে দিলে ওরা থামবে না। কয়েক বছর পর আবার আসবে।

কোজাক বলেন, যারা এখানে আসেনি, যারা ভাই, বন্ধু হারায়নি—তারা বলবে কিছু জমি ছেড়ে দাও। তারা বোঝে না কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এক মিটার জমিও ছাড়া উচিত নয়।

এই যুদ্ধের দাম ইউক্রেন চুকিয়েছে প্রতিটি চৌরাস্তার পাশে স্থাপিত স্মৃতিফলকে, শহরের কেন্দ্রে থাকা মৃত সেনাদের দেয়ালে দেয়ালে ছবি, আর সারি সারি কবরস্থানে।

সামনের সারির যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরে, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর জাপোরিজ্জিয়ার এক কবরস্থানে গিয়ে দাঁড়ান ইয়ানা মেলনিকোভা। ২২ বছর বয়সী ছেলে ভ্লাদিস্লাভের কবরের পাশে বসে তার পছন্দের গরম চকোলেট আর চকলেট রোল রাখেন তিনি। সঙ্গে তার ১৩ বছরের মেয়ে নিকোল।

ভ্লাদিস্লাভ ছিলেন ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর একজন ড্রোন অপারেটর। ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ রুশ হামলায় নিহত হন।

শান্তি আলোচনার খবরে আশাবাদী হতে পারছেন না ইয়ানা। তিনি বলেন, এই যুদ্ধ আমার কাছে অনন্তকাল মনে হয়। রাশিয়া চায় আমাদের জমি, তাদের লোভের শেষ নেই।

জাপোরিজ্জিয়া অঞ্চলের অংশবিশেষ এখনও রুশ দখলে। রাশিয়া স্পষ্টভাবেই চারটি অঞ্চল—জাপোরিজ্জিয়া, লুহানস্ক, ডনেস্ক ও খেরসন—চায় নিজেদের দখলে।

ইয়ানা বলেন, না, আমি ইউক্রেনেই থাকতে চাই, রাশিয়ায় নয়। বুচার মতো জায়গায় কী করেছে তারা—তাতে আমরা জানি, রুশ দখলের মানে কী।

ভ্লাদিস্লাভের কবরের পাশে বড় গর্ত, যেখানে কয়েক মাস আগে বোমা পড়েছিল। চোখে জল নিয়ে ইয়ানা বলেন, আমি চাই আমার সন্তানের মৃত্যু বৃথা না যাক। একদিন বিজয় আসবে, আর সমগ্র ইউক্রেন হবে মুক্ত।

সূত্র: বিবিসি