সিএএ-পরবর্তী কোন পথে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি

ভারতের বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ও জনসংখ্যা গণনা (এনপিআর) নিয়ে  সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও সহিংসতা কোনও নির্দিষ্ট ধরন মেনে হচ্ছে না। এটিকে ভারতের বিরোধী দলগুলোর আংশিক ব্যর্থতা বলে বর্ণনা করা যায়। বর্তমানে দেশের ২৮টি রাজ্যের ১২টি শাসন করছে বিরোধীরা। তাদের এই ব্যর্থতা দুই পর্যায়ে ঘটছে। বিরোধী দলগুলো বিজেপিবিরোধী কোনও কর্মসূচিতে একাট্টা হতে পারেনি। এমনকি নিজেদের শাসিত রাজ্যগুলোতেও ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি দিতে পারেনি তারা। 

mamata_rally_pti-770x433

বিরোধীদের সম্মিলিত ব্যর্থতা আরও নিশ্চিত হয়েছে কয়েকদিন আগে কংগ্রেস আয়োজিত এক বৈঠকে। ওই বৈঠক থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি), বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) ও সমাজবাদী পার্টি (এসপি)।

বিরোধীদের এই সম্মিলিত ব্যর্থতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে বিক্ষোভের প্রভাব। রাজ্য থেকে রাজ্যে বিক্ষোভের ধরন বদলে গেছে। সরকারিভাবে জম্মু-কাশ্মির, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণের প্রতিক্রিয়ার ওপর নিবিড় নজরদারি রয়েছে। কারণ জম্মু-কাশ্মির ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য। আর আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠী। এদের বেশিরভাগই সুন্নি মুসলমান।

সম্প্রতি তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গে কয়েকদিন ধরে সহিংস বিক্ষোভ হয়েছে। নষ্ট হয়েছে রেলওয়ে ও সরকারি সম্পত্তি। বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশে পুলিশি তৎপরতা ও সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ২৫ জন। জম্মু ও কাশ্মিরে ফারুক আবদুল্লাহ, তার ছেলে ওমর আবদুল্লাহ ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির মতো জনপ্রিয় নেতাদের পাশাপাশি পাকিস্তানপন্থী হুরিয়াত নেতাদের বন্দি রাখার প্রতিক্রিয়া ছিল তুলনামূলক শান্ত।  

আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ মাঝে মাঝেই বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলে। দুটি রাজ্যের সঙ্গেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। আসামের সিএএবিরোধী বিক্ষোভ সব বড় জনগোষ্ঠীকেই শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। অহমিয়া, বাঙালি, হিন্দু, মুসলমান, উপজাতি সব জনগোষ্ঠী এখন কেবল পারস্পরিক সন্দেহের কবলেই পড়েনি, অভ্যন্তরীণভাবে ভঙ্গুরও হয়ে গেছে। ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে সন্দিহান তারাও। তবে এসব বিষয় নিয়ে বিশদ জানতে হলে আরও সময় লাগবে। তবে এখন এটা বলা যায় যে, ভারতে অহমিয়ারাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমান ও ভবিষ্যতে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে বিপদে পড়তে যাচ্ছে তারা।

পশ্চিমবঙ্গে অস্থিরতা শুরুর পরই রাজনৈতিক ফায়দা নিতে সময়ই নষ্ট করেননি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকেই মনে করছেন বিশেষ করে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতাদের অভিযোগ, মমতা মুসলমান বিক্ষোভকারীকে রেলওয়ে স্টেশন, ট্রেন, লাইনে ৭২ ঘণ্টা ধরে ভাঙচুর চালানোর সুযোগ দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তৃণমূলের যুক্তি তারা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে নয়।

এমনকি বিজেপি নেতা, বিশ্লেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা ওই সহিংসতার নিন্দা করলেও মমতা ও তৃণমূল নেতারা পরোক্ষভাবে বিক্ষোভকারীদের পক্ষ নিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিক্ষোভকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে অনেক সময়ই অতিরঞ্জিত করে ফেলে। অনেক বিশ্লেষকই একে তৃণমূলের ভোটের ব্যাংক রক্ষার নীতি হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন মুসলমান ভোট ব্যাংক রক্ষার মাধ্যমে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য এখনই প্রচারণা শুরু করেছেন তৃণমূল নেত্রী।

যদিও মুখ্যমন্ত্রী জানেন ২০২১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ভোট পাবে না তার দল। আর এটা নিয়েই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। জনসভায় ইসলামিক কবিতা আওড়ালেও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখতে পারেননি তিনি।

ফলে মমতার মুসলমানদের ভোট ব্যাংক জিম্মি করে রাখার চেষ্টা প্রকাশ্য সভাতেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ইত্তেহাদুল মজলিশ এ মুসলেমিন (এআইএমআইএম) নেতা আসাদ উদ্দিন ওয়াইসির মতো নেতাদের প্রতি মুসলমানদের ঝোঁক বাড়তে থাকায় শঙ্কা বাড়ছে মমতার।

সম্প্রতি বিহার ও মহারাষ্ট্রে কিছু আসন জেতা এআইএমআইএম এখন শাখা বাড়াতে চাইছে। বিপুল মুসলমান অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গের ওপর তাদের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। আসাদ উদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের পরিস্থিতি ভারতের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। মমতা  ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া তাদের জন্য কিছুই করেননি। মুসলমানরা আজ চাকরি, শিক্ষা ও আইটি প্রশিক্ষণ চায়। মসজিদের ইমামদের ভাতা দিয়ে তাদের খুশি করা যাবে না’।

মমতা বন্দোপাধ্যায় তাকে বিজেপি সমর্থিত উগ্রবাদী আখ্যা দিলে সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পান ওয়াইসি।

মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঘিরে আগের চেয়ে ছুটি বাড়িয়েছে তৃণমূল সরকার। অবাঙালি মুসলমানদের তুষ্ট করতেও নিজের মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মমতা। উৎসবগুলোতে তিনি নিয়মিত হিজাব পরেন। আসাদ উদ্দিন ওয়াইসি তাকে এই ধরনের লোক দেখানো তৎপরতা বন্ধ করে মুসলমানদের সত্যিকার সমস্যার দিকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে সস্তা জনপ্রিয়তার রাস্তা ছেড়ে বের হননি তিনি।

আর এসব করতে গিয়ে বহু হিন্দুকে (জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ) ক্ষুব্ধ করেছেন তিনি। বিগত লোকসভা নির্বাচনে এসব ক্ষুব্ধ ভোটাররা বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। বিশেষত দাঙ্গাবাজদের হিন্দু-মুসলমান হিসেবে বিভক্ত করায় মমতার ওপর ক্ষুব্ধ হিন্দুরা। মমতার আমলে দেগঙ্গা, ক্যানিং, দুলাগারি, অশোকনগরসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলমান সমাজবিরোধীদের সশস্ত্র হামলায় আহত হয়েছে তারা।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সমাজকর্মী ড. মুদার পাথেরিয়ার নেতৃত্বে কলকাতার মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা মমতাকে খোলা চিঠি লিখে অপরাধের সময় পুলিশকে বিশেষ সম্প্রদায়ের পক্ষ না নিয়ে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানান।

পাথেরিয়া একা নন। প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা ও সাবেক আইনপ্রণেতা সরদার আমজাদ আলী সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি বেশ কয়েকবারই মুসলমানের তোষণ নীতি থেকে সরে আসার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তার ভোট ধরার কৌশলে উগ্রবাদীরা উৎসাহ পাচ্ছে বলেও সতর্ক করেন তিনি।

এর আগে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও তাকে একই রকমভাবে সতর্ক করেন।

এছাড়া গত ৮ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের ডাকা অবরোধে বামফ্রন্ট (সিপিআই-এম) সমর্থন দেওয়ায় বিচলিত হয়েছেন মমতা। সম্প্রতি বামফ্রন্টের ডাকা মিছিল সমাবেশগুলোতেও বড় ধরনের জমায়েত হচ্ছে। কয়েকটি এলাকায় কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের ভালো সমর্থন রয়েছে বলে ধারনা করা হয়।

আর এসবের অর্থ হলো, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতার মুসলমান ভোট ব্যাংক তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। একভাগ যেতে পারে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস ব্লকে আর এক ভাগ যেতে পারে এআইএমআইএম-এর ঝুড়িতে। ২০২১ সালে দলটি বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে মুসলিম ভোটব্যাংকের ওপর মমতার একাধিপত্ব খর্ব হতে পারে।

এসব কারণই তৃণমূল ও মমতা শঙ্কায় রয়েছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন সিএএ-এর বিরোধিতা করে ৭০ শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভোট হারাচ্ছেন তারা। তবে মুসলিম ভোট ব্যাংক ও অমুসলিম ভোটারদের মধ্যে ঐক্য গড়তে পারলেই কেবল তিনি তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন।