মমতাকে মেসির সঙ্গে তুলনা করে বিজেপিকে একহাত নিলেন জয়প্রকাশ

তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মেসির’ সঙ্গে তুলনা করে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিকে তীব্র কটাক্ষ করলেন সাময়িক বরখাস্ত জয়প্রকাশ মজুমদার। মঙ্গলবার কলকাতা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনে অপর বরখাস্ত বিজেপি নেতা রীতেশ তেওয়ারিকে পাশে বসিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে তুলোধোনা করে জয়প্রকাশ বললেন, ‘রাজ্যের সভাপতি আড়াই বছর রাজনীতি করছেন। সাধারণ সম্পাদকের সংগঠনের অভিজ্ঞতা ২ বছর। সম্মিলিত অভিজ্ঞতা ৫ বছরের কম। লড়াই হচ্ছে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে। যিনি সারা ভারতে কুশলী, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেত্রী। বিরোধী হলেও অস্বীকার করা যায় না। মেসির টিমের সঙ্গে নামবো, তিন দিন অনুশীলন। কেন্দ্রের কাছে সব বিবরণ পাঠিয়েছিলাম।’

সাংবাদিক সম্মেলনে বিজেপির রাজ্য নেতাদের প্রতি চরম বিষোদ্গার করে জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, ‘২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে লড়েছিলেন রাজ্যের নেতারা। আস্তে আস্তে পরিবর্তন হলো। পশ্চিমবঙ্গে ১৮টি আসনপ্রাপ্তির জায়গায় যারা বিজেপিকে আনলেন, তাদের ওপর ভরসা করা যাবে না। ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে হয় অন্য দল থেকে লোক আনতে হবে, নয়তো বাইরের লোক এনে রাজ্য বিজেপিতে ভোট বৈতরণী পার করাতে হবে। তৃণমূল থেকে আসা লোকেরা তালিকা দিয়েছে। তাদের প্রার্থী করা হয়েছে। যার বিরুদ্ধে লড়াই করলেন কর্মীরা তিনি বিমানে দিল্লি উড়ে গিয়ে টিকিট পকেটে করে নিয়ে আসলেন। ২০ বছর ধরে বিজেপি করেও কর্মীরা টিকিট পেলেন না। কষ্ট হয়েছে সাধারণ কর্মীদের। তৃণমূলের প্রচারের অভিমুখ ছিল বাঙালি অস্মিতা। নেতাজি, চিত্তরঞ্জনকে আলাদা দল করতে হয়েছে। বাঙালি অস্মিতাকে ছুঁয়েও দেখলো না বিজেপি। এটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, সেটা পরে বোঝা যাবে। বাংলার নেতৃত্বকে জব্দ করার পরিকল্পনা হয়েছিল।’

২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের হারের পর্যালোচনা করতে দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন জয়প্রকাশ। তিনি বলেন, ‘২০০ আসনের টার্গেট নিয়েছিলাম। পেলাম ৭৭ আসন। অথচ হারের কোনও পর্যালোচনা হয়নি। ভার্চুয়াল বৈঠকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বা মাইক বন্ধ করে দিয়েছে। কেন এটা হলো, কীভাবে দোষত্রুটি শুধরে নেবো, তার কোনও আলোচনাই হলো না। রোগ হলে চাদর ঢাকা দিলে সারে না। চিকিৎসা করাতে হয়। কেন্দ্রকে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়েছি আমি।’

দলে কাজের লোকের চেয়ে কাছের লোক গুরুত্ব পায় বলেও অভিযোগ করেছেন বরখাস্ত হওয়া এই বিজেপি নেতা। তিনি বলেন, ‘দিলীপদার আরও এক বছর সময়কাল ছিল। ২০২২ সালের শেষে সাংগঠনিক নির্বাচন হবে। সঙ্গে সঙ্গে জেলা সভাপতি ও রাজ্যের পদাধিকারীদের নাম ঘোষণা করে দিলেন। কাজের লোকের থেকে কাছের লোকের তত্ত্বের ওপরে তৈরি হয়েছে কমিটি। ৪২ সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অন্তত ৩২টি জেলার সভাপতিকে জেলার লোকেরা চেনেন না। দিলীপবাবুও বলেছেন, আরে ৬ বছর সভাপতি ছিলাম। আমিই চিনিই না। তৃণমূলকে হারিয়ে রাজ্য দখল নয়, সংগঠন দখল করাই উদ্দেশ্য। এর পিছনে রয়েছেন টুইটার মালব্য। নিজের লোক নিয়োগ করছেন। ওদের এজেন্ডা তৃণমূলকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া।’

ব্ঙ্গ বিজেপির নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে জয়প্রকাশ বলেন, ‘ভোটের কয়েক মাস আগে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে সংগঠনে চরম অনভিজ্ঞ লোককে বসানো হলো। বাইরে থেকে এসে কেন্দ্রে ধরে ধরে ভোট পরিচালনা করাতে লাগলেন নেতারা। তারা বাংলা জানেন না। অথচ বাংলা দখল করবেন। এটা ঐতিহাসিক ভুল হয়েছে। বাংলার বাইরের লোকজন আনা হয়েছিল। শাসক দল বলেছিল বহিরাগত। কৌশলের বদলে ঠকানো হয়েছে কর্মীদের। সেই সময় এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেছিলেন, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) সুব্রত চট্টোপাধ্যায় ও সভাপতি দিলীপ ঘোষকে বাদ দিয়ে রাজ্যে বিজেপিকে জয়ী করে দেখিয়ে দেবো। দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান থেকে লোক এনে দেখিয়ে দেবো তোমাদের কোনও দরকার নেই।’

ভোটের পর আক্রান্ত কর্মীদের পাশে দাঁড়ায়নি বিজেপি বলে অভিযোগ করে জয়প্রকাশ বলেন, ‘আক্রান্ত কর্মীদের পাশে থাকার চেয়ে হাইকোর্টে গেলে বেশি লাভ হবে বলে ভেবেছেন বিজেপি নেতারা। হাইকোর্টের ওপর নির্ভর করে লড়াই করেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাস্তায়, মাঠেঘাটে তাকে দেখা গিয়েছে। এটাই বাংলার রাজনীতি।’

বঙ্গ বিজেপিতে মুসলিমদের স্থান নেই এমনও অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, ‘সংখ্যালঘু মোর্চায় কোনও সংখ্যালঘু মুসলিম পাওয়া গেলো না। খ্রিষ্টানকে সভাপতি করা হয়েছে। ১৯৫১ সালে প্রথম জনসঙ্ঘের সভা হয়েছিল গড়বেতায়। সেই কমিটিতে সহ-সভাপতি ছিলেন আবদুল আলি। একজন মুসলিম নেতাকে পেলাম না। একজন মুসলিম নেত্রী বলছেন, তাকে এখানে কাজ করতে না দিয়ে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

বাংলার বিজেপিকে আন্দোলন বিমুখ করে দিয়েছেন রাজ্য নেতারা– এমনটাই মনে করেন জয়প্রকাশ মজুমদার। তিনি বলেন, ‘স্কুল ও কলেজ খোলার দাবি উঠছে। এখনকার বিজেপি নেতারা গর্ব করে বলছেন, আমরা এবিভিপি করে আসা লোক। বাংলার ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে বা কটা কলেজের ছাত্র পরিষদ জিতেছে, সেটা জানি না। শিক্ষকরা চাকরি পাচ্ছেন না, স্কুল-কলেজ বন্ধ অথচ কোনও আন্দোলন নেই। কিন্তু রাজ্য বিজেপি নাকি চালাচ্ছে এবিভিপি!’

এদিকে জয়প্রকাশ মজুমদারের এই মমতাস্তুতি নিয়ে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুনাল ঘোষ বললেন, ‘আমরা এতদিন এগুলোই বলেছি। কিন্তু তারা বিজেপির হয়ে যুক্তি দিয়েছেন। এখন জয়প্রকাশবাবুদের মুখ থেকে সত্যি বেরিয়ে পড়েছে। উনি হয়তো দেরিতে বলছেন, কিন্তু বাস্তবটাই বলছেন।’

এর জবাবে রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার মনে করালেন প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কীভাবে জ্বলে উঠেছিলেন ১৭ বছরের কম বয়সের এক কিশোর সচিন তেন্ডুলকার।

জয়প্রকাশের কটাক্ষের জবাবে সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘যারা সাংবাদিক বৈঠক করেছেন, তারা এখন আমাদের দলের কেউ নন। তবে আমি মনে করাতে চাই সেই ১৭ বছরের কিশোরের কথা, যিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাট হাতে ঝড় দেখিয়েছিলেন।’

সাংবাদিক বৈঠকে জয়প্রকাশ ও রীতেশ অভিযোগ করেছেন, কেন কিছু না জানিয়েই এভাবে তাদের শাস্তি দেওয়া হলো। এমন অভিযোগের জবাবে সুকান্ত মজুমদারের বলেন, ‘আমাদের কাছে কিছু জানতে চাননি। উনি মিডিয়ার কাছে জানতে চাইছেন। মিডিয়া উত্তর দেবে।’

সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাজ্য দফতরে সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়সহ রাজ্য বিজেপির কিছু নেতা উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেন। ভার্চুয়াল মাধ্যমে রাজ্য নেতারা বৈঠকে যোগ দেন।