তৃণমূল সরকারের বর্ষপূর্তি

মমতার জনমুখী প্রকল্পে দিশাহীন বিরোধীরা!

২০২৩ সালে বাংলায় পঞ্চায়েত ভোট। আর এই ভোটে নিরঙ্কুশ সাফল্য পেতে রাজ্যের জনমুখী সরকারি প্রকল্পকেই হাতিয়ার করতে চাইছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও বিরোধীদের দাবি, এই রাজনীতির ফলে চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে চলেছে রাজ্য। কিন্তু বিজেপি, বাম ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে চলা একাধিক জনমুখী প্রকল্প অতীতের মতোই ফের ভোটে জেতার ক্ষেত্রে তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারে, এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ।

যে সরকারি প্রকল্পগুলো নিয়ে একুশের ভোট বাজিমাত করেছে বলে দাবি করে তৃণমূল, তা নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারীর সাফ বক্তব্য, ‘দেশে ৮০ কোটি মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশনের ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেটাকে এখানে ‘খাদ্য সাথী’ হিসেবে চালাচ্ছেন। বার্ধক্য ভাতার ৮০ শতাংশ টাকা কেন্দ্রীয় সরকার দেয়। জলজীবন মিশন প্রকল্পকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজের বলে দেখাচ্ছেন। ১২ কোটি ৮৩ লাখ ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দিয়েছে কেন্দ্র, সেখান থেকে এ রাজ্যেও এসেছে।'

এদিকে বঙ্গ বিজেপির অভিযোগের সমর্থনে ইতিমধ্যেই ভারতের জল শক্তি মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী প্রহ্লাদ সিং প্যাটেল বলেছেন, ‘কিছু রাজ্য কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদলালে, কেন্দ্র আর টাকা দেবে না।’

এসব প্রকল্প নিয়ে তৃণমূলের প্রচারের পাল্টা হিসেবে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নকেই বারবার সামনে আনতে চাইছে বিজেপি। রাজ্যে জনমুখী প্রকল্পের বিপুল অর্থব্যয় নিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ‘পশ্চিমবঙ্গ আগামীতে শ্রীলঙ্কা হতে চলেছে’ এই বলে একলাইনে তার বিরোধিতা শেষ করেন।

উল্টো, পশ্চিমবঙ্গে একুশের বিধানসভা ভোটের একবছর হয়ে গেলেও ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস এখনও রাজ্যর প্রধান বিরোধী দলের তৃণমূল সরকার বিরোধী রাজনীতির মূল এজেন্ডা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধি, সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ, শিল্প, দেউচা-পাঁচমির কয়লা খনি কেন্দ্র করে সমস্যাসহ একাধিক বিষয়ে গত একবছরে তেমন আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে গড়ে তুলতে পারেনি গেরুয়া শিবির। যা জনমনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

উল্টো একুশের ভোটের পর ব্যাপক গোষ্ঠীদ্বন্ধ জেরবার হয়ে পড়েছে মুরলিধর লেনের দলটি। প্রভাব পড়ছে একুশের পরবর্তী প্রতিটি ভোটে।

রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করে, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি এখন রাজ্যের রাজনীতিতে ফিরতে এখনও দিল্লি নির্ভরতা ছাড়তে পারেনি। তারা ভাবছেন ঊনিশের লোকসভা ভোটের মতো মোদি ম্যাজিক বারবার আসবে। এমনটা যে হয় না, তার প্রমাণ একুশের ভোটেই হাতে-কলমে পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি। আন্দোলন না থাকলে সংগঠন তৈরি হয় না, এটা বুঝতে সময় লেগে যাচ্ছে বিজেপির।

অপরদিকে, বাংলায় শক্ত অবস্থানে না থেকে আন্দোলনের ভালোভাবেই টিকে রয়েছে বামেরা। মমতা সরকারের জনমুখী প্রকল্পকে নিজের দিকে টানার রাজনীতি বললেও সিপিএম স্বীকার করছে, তারা তৃণমূলের এই গেমপ্ল্যানের পাল্টা জনগণের সামনে বিকল্প হাজির করতে পারছে না।

সিপিএমের ২৬তম রাজ্য সম্মেলনের রির্পোটে তারা বলেছেন, ‘বরাবর প্রান্তিক, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষকে পাশে নিয়েই গড়ে উঠেছে বামপন্থী আন্দোলন। নির্বাচনি বাক্সেও তার ফল মিলেছে। কিন্তু এখন তৃণমূল সরকার রাজ্যের বড় অংশের মানুষকেই বেঁধে ফেলেছে নানা প্রকল্পের বাঁধনে। সরকার থেকে সুবিধা পাওয়ায় বিরোধীদের অনেক কথাই মানুষ আপাতত শুনতে চাইছেন না। বামেদের মতে, কঠিন হয়ে যাচ্ছে লড়াই।’

অপর দিকে, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটকে লক্ষ্য করেই নিজের ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দিয়েছে তৃণমূল। সে লক্ষ্যেই এবার নতুন জনসংযোগ কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হয়েছে। দুয়ারে সরকার শিবিরে মধ্য দিয়ে রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, খাদ্যসাথী, শিক্ষাশ্রী, তফশিলি জাতি, আদিবাসী এবং ওবিসিদের প্রশংসাপত্র, জয় জোহার, তফশিলি বন্ধু পেনশন প্রকল্প, মানবিক প্রকল্প, ১০০ দিনের কাজ, ঐক্যশ্রী, লক্ষ্মীর ভা-র, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রকল্প, কৃষক বন্ধু,বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা, কৃষি জমির মিউটেশনের মতো বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা আরও ব্যাপক পর্যায়ে তৃণমূলস্তরে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছে ঘাসফুল শিবির।

জানা গেছে, আগামী ৫ মে তৃণমূলের মেগা বৈঠক ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, জেলা সভাপতি ও শাখা সংগঠনগুলোর প্রধানদের নিয়ে বৈঠক তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সংক্রান্ত ব্লুপ্রিন্ট তুলে ধরবেন দলের কাছে। সামাজিক সুরক্ষামূলক প্রকল্পগুলোতে ব্লকে ব্লকে প্রচার করা হবে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, উন্নয়নের প্রকল্পে বাজিমাতের পাশাপাশি বিরোধী দলগুলো গৃহপালিত হয়ে যাওয়ার কারণে তৃণমূল বাংলাকে সুরক্ষিত মনে করেই, এবার গত একবছর ধরে দেশের অন্য রাজ্যগুলোর সংগঠন বিস্তারে মনযোগ দিতে পেরেছে। যা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপিকে চাপে ফেলতে পারে।

আর এ কারণেই আগামী দিনে মমতাকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বেধে রাখতে না পারার ব্যর্থতার মাশুল গুনতে হতে পারে রাজ্য বিজেপিকে।