ভারতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে কীসের এত জলঘোলা?  

রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্টের পদটি ভারতে ‘সেরেমোনিয়াল হেড’ বা আলঙ্কারিক প্রধানের। তারপরও দিল্লির রাইসিনা হিলসে রাষ্ট্রপতি ভবনের বাসিন্দা কে হবেন, তা নিয়ে প্রতি পাঁচ বছর অন্তরই ভারতে বেশ কৌতূহল দেখা যায়। তবে এবারে দেশের ১৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্রৌপদী মুর্মু বনাম যশবন্ত সিনহার লড়াইকে ঘিরে যে ধরনের রাজনীতির মারপ্যাঁচ দেখা যাচ্ছে তা রীতিমতো নজিরবিহীন।  

নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১৮ জুলাই। তার আগে এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোট ১১৫টি মনোনয়ন পত্র জমা পড়লেও নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, মাত্র দুটি মনোনয়নই সব শর্ত মেনে বৈধতা অর্জন করেছে। যার একটি ক্ষমতাসীন বিজেপি জোটের প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুর, অপরটি সতেরো-আঠারোটি বিরোধী দলের সর্বসম্মত প্রার্থী যশবন্ত সিনহার। 

নির্বাচনে দ্রৌপদী মুর্মুর জয় এখন ক্রমেই নিশ্চিত হয়ে উঠলেও শুরুতে কিন্তু পরিস্থিতিটা তেমন ছিল না। ভারতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে বিভিন্ন রাজ্যের এমএলএ ও জাতীয় সংসদের এমপিদের নিয়ে গঠিত একটি ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ – সেখানে বিজেপি ও তার শরিক দলগুলোর মোট ভোট ৫০ শতাংশের চেয়ে কিছুটা কমই ছিল। ফলে বিরোধী দলগুলো মনে করেছিল, তারা যদি যৌথভাবে একজন উপযুক্ত প্রার্থীকে বিজেপির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে পারে তাহলে নরেন্দ্র মোদি সরকারকে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা সম্ভব। 

এমন কী, সেই বিরোধী প্রার্থী যদি শেষ পর্যন্ত জিতে যান তাহলে ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে এই বার্তাটাও দেওয়া যাবে যে বিরোধীরা হাত মেলাতে পারলে নরেন্দ্র মোদি মোটেই অপরাজিত নন! 

ফলে বিরোধী দলগুলোর তরফে যৌথ প্রার্থী বাছাইয়ের উদ্যোগটা প্রথম নেন এমন একজন – জাতীয় রাজনীতিতে যার নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা সুবিদিত। তিনি আর কেউ নন, পশ্চিমবঙ্গের টানা তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিতে গত মাসের মাঝামাঝি মমতার ডাকে বিরোধী দলগুলো প্রার্থী বাছাই করতে বৈঠকেও বসে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও তাতে যোগ দেয়। কিন্তু সেখানে কোনও মতৈক্য হয়নি। 

যশবন্ত সিনহা ও দ্রৌপদী মুর্মুর

ভারতীয় রাজনীতির ‘চাণক্য’ বলে পরিচিত এনসিপি দলের সভাপতি শরদ পাওয়ার, কাশ্মিরে ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রবীণ নেতা ফারুক আবদুল্লা ও অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ আমলা ও কূটনীতিবিদ গোপালকৃষ্ণ গান্ধী – সবাই একে একে বিরোধী শিবিরের প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।  

অবশেষে শরদ পাওয়ারের সভাপতিত্বে বিরোধী দলগুলো দিল্লিতে ২১ জুন আবার বৈঠকে বসে এবং প্রার্থী হিসেবে সাবেক আমলা তথা সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যশবন্ত সিনহার নামে সিলমোহর দেয়। বিজেপি থেকে পদত্যাগী যশবন্ত সিনহা সেদিন সকাল পর্যন্তও তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম সহ-সভাপতি ছিলেন, কিন্তু ‘বৃহত্তর দায়িত্ব’ নেওয়ার কথা বলে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অনুমতি’ চেয়েই দল থেকে পদত্যাগ করেন এবং বিরোধীদের যৌথ প্রার্থী হতে রাজি হয়ে যান। 

এ পর্যন্ত বিরোধীদের অঙ্ক ঠিকই ছিল – কিন্তু সে দিন রাতেই শাসক জোট তাদের প্রার্থী হিসেবে আদিবাসী নেত্রী ও উড়িষ্যার সাবেক বিজেপি এমএলএ দ্রৌপদী মুর্মুর নাম ঘোষণা করে নির্বাচনের পাশা উল্টে দেয়। প্রথমত তিনি একজন নারী, শিক্ষাব্রতী, তারপর অনগ্রসর আদিবাসী সমাজ থেকে লড়াই করে উঠে আসা – এমন ঝকঝকে বায়োডাটা নিয়ে দ্রৌপদী মুর্মু প্রথম রাউন্ডেই কড়া চ্যালেঞ্জে ফেলে দেন যশবন্ত সিনহাকে। ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গভর্নর হিসেবে তার পাঁচ বছরের সফল কার্যকালও মুর্মুর পক্ষে কাজ করে। 

উল্টোদিকে সাবেক ক্যাবিনেট সচিব ও এক কালের ঝানু আমলা যশবন্ত সিনহাকে মানুষ কিন্তু একজন সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদ হিসেবেই দেখে। সিভিল সার্ভিস থেকে স্বেচ্ছা-অবসর নিয়ে তিনি এককালে প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। পরে বিজেপিতে যোগ দিয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ীর ক্যাবিনেটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির আমলে ক্যাবিনেটে ঠাঁই না-পেয়ে ও দলে কোণঠাসা হতে হতে তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেন – এবং একটা পর্যায়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। 

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যশবন্ত সিনহা যে দ্রৌপদী মুর্মুকে আদৌ বিপদে ফেলতে পারবেন না, তা স্পষ্ট হয়ে যায় ২১ জুন রাতেই – যখন উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক মুর্মুর প্রার্থিতাকে স্বাগত জানিয়ে তাকে সমর্থন জানানোর কথা ঘোষণা করেন। দ্রৌপদী মুর্মুকে উড়িষ্যার গর্ব বলেও বর্ণনা করেন তিনি। এরপর একে একে অন্ধ্রে ক্ষমতাসীন ওয়াই এস আর কংগ্রেস, মায়াবতীর দল বহুজন সমাজ পার্টির মতো দলগুলোও দ্রৌপদী মুর্মুকে সমর্থনের কথা জানায় – ফলে ‘ইলেক্টোরাল কলেজে’ বিজেপির সামান্য যেটুকু ঘাটতি ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি সমর্থনের প্রতিশ্রুতি মিলে যায়। এরপর মহারাষ্ট্রে শিবসেনার বেশিরভাগ বিধায়ক বিদ্রোহ করে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানোর পর দ্রৌপদী মুর্মুরে জয় নেহাত সময়ের অপেক্ষা। 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

হতোদ্যম বিরোধী শিবিরকে আরও হতাশ করে গত ১ জুলাই রথযাত্রার দিনে কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ঘোষণা করেন, ‘আগে জানলে আমিও দ্রৌপদী মুর্মুর নাম ভেবে দেখতাম (সমর্থন দিতে পারি কি না)। তবে বিজেপি তো আগেভাগে আমাদের কিছু জানায়নি।’ 

পরাজয় অবধারিত জেনেও ‘আদর্শ ও বিচারধারা’র লড়াই হিসেবে যারা যশবন্ত সিনহাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সমর্থন করছে, সেই কংগ্রেসও মমতার এই মন্তব্যে হতাশা গোপন করেনি। যিনি নিজে সর্বসম্মত বিরোধী প্রার্থী খোঁজার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই ব্যানার্জি নিজেই যখন আপাতদৃষ্টিতে সেই প্রার্থীর থেকে দূরত্ব বাড়াচ্ছেন – তাতে অন্য বিরোধী দলগুলোও যারপরনাই বিরক্ত বোধ করছে।  

অপ্রস্তুত বামপন্থীরাও (তারাও যশবন্ত সিনহাকে সমর্থন করছে) এখন বলতে শুরু করেছেন, মমতার ওপর বিজেপির চাপ আসছে বলেই কি তিনি শেষ মুহুর্তে এভাবে ভোল বদলালেন? 

আসল কারণ যাই হোক – রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের এই প্রেক্ষাপট আরও একবার প্রমাণ করে দিলো, ভারতে বিরোধী দলীয় ঐক্যের ছবিটা এখনও কতটা ছন্নছাড়া। দুই বছর বাদে লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জে ফেলতে হলে দেশের সবগুলো বিরোধী দলগুলোকে যে প্রায় অসাধ্যসাধন করতে হবে, স্পষ্ট হয়ে গেল সেটাও।