সুয়েজ খালের বিকল্প নিয়ে আলোচনায় ইসরায়েল রুট

২০ হাজার কন্টেইনার ভর্তি এভার গিভেন নামের দানবাকৃতি জাহাজটির মাথা যখন ২৩ মার্চ সুয়েজ খালের তীরে বালিতে আটকে যায়, তার পরিণতি যে কত গুরুতর হতে পারে মিসর হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে তা বোঝেনি। কিন্তু পরের ছয় দিন দিনরাত ২৪ ঘণ্টা চেষ্টায় জাপানি মালিকানাধীন জাহাজটি উদ্ধার করে বিশ্ব বাণিজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পানিপথটি চালুর পর পাহাড় সমান লোকসানের হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে।

এভার গিভেন জাহাজটি আটকে রেখে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান শুরু করেছে মিসর। যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করা হচ্ছে। জাহাজটি চালানোতে কোনও ভুল হয়েছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ক্যাপ্টেনকে জেরা করা হচ্ছে।

সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ হুঁশিয়ার করেছে যে, তদন্তে সহযোগিতা না করলে জাহাজের ক্রুদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী অপরাধে মামলা হবে। শুধু মিসর নয়, শত শত কোটি ডলার লোকসানের ভাগীদার হয়েছে ডজন ডজন দেশ এবং হাজার হাজার ব্যবসায়ী। এর কারণ লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে সংযোগকারী ১২০ মাইল দীর্ঘ এই খাল দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের ১২ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয়। বিশেষ করে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যের একটি লাইফ-লাইন হলো এই খালটি।

এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ওসামা রাবি বলেছেন, জাহাজটিকে ভাসানোর খরচ এবং ছয় দিন ধরে খালটি বন্ধ থাকার জন্য ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার বা তারও বেশি হতে পারে।

জাপানি জাহাজ মালিকের কাছ থেকে এই ক্ষতি দাবি করা হবে কিনা, তা অবশ্য খোলাসা করেননি ওসামা রাবি। কিন্তু টাকার এই লোকসানের চেয়ে অন্য আরেকটি বিষয় এখন হয়তো মিসরের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেটি হলো, দুর্ঘটনার পর নতুন করে সুয়েজ খালের বিকল্প একটি খালের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু।suez canal 03

বিকল্প খালের ম্যাপে ইসরায়েল

২০২১ সালের ১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে বিজনেস ইনসাইডার নামে একটি পত্রিকায় ১৯৬৩ সালের একটি গোপন সরকারি নথি প্রকাশ করা হয়। সেখানে সুয়েজ খালের বিকল্প হিসেবে ইসরায়েলের ভেতর দিয়ে একটি খাল তৈরির পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। মার্কিন বাণিজ্য দফতরের গোপন ওই নথি ১৯৯৬ সালে আংশিকভাবে প্রকাশ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ওই গোপন পরিকল্পনায় ১৬০ মাইল লম্বা একটি খাল খননের জন্য ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমির তলায় ৫২০টি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ করার কথা বলা হয়েছিল। বিজনেস ইনসাইডারের রিপোর্টটি বিশেষ করে ইসরায়েলের মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। একটি খাল তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়েও দেশটির মিডিয়ার মাতামাতি শুরু হয়েছে।

এর মধ্যেই ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বৃহস্পতিবার এক রিপোর্টে যুক্তরাজ্যের সরকারি সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলছে যে, সুয়েজ খালে দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে ইসরায়েল ও মিসরের সীমান্ত দিয়ে নতুন একটি খাল তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে জাতিসংঘের বাণিজ্যিক-রুট সম্পর্কিত কমিটিতে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

গার্ডিয়ানের রিপোর্ট বলছে, কয়েক বছর আগে জাতিসংঘ টানেল তৈরিতে বিশেষজ্ঞ একটি কোম্পানিকে দিয়ে সুয়েজের বিকল্প একটি খালের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল। সেখানে ওই কোম্পানি বলেছিল যে, পাঁচ বছরে এমন একটি কৃত্রিম খাল তৈরি করা সম্ভব।

লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক রাজনীতির একজন বিশ্লেষক সামি হামদি। তিনি বলেন, সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ এবং তা সম্ভব না হলে বিকল্প একটি পানিপথ তৈরির পরিকল্পনা ইসরায়েল বহুদিন ধরেই করছে। আর তাতে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা অনেক দেশের।

সামি হামদি বিবিসি-কে বলেন, ‘১৯৫৬ সালে ইসরায়েল সুয়েজের নিয়ন্ত্রণ নিতে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সমর্থন নিয়ে মিসরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছিল। বাস্তবতার কারণে হয়তো বিষয়টি বারবার চাপা পড়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই পানিপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে ইসরায়েল কখনোই সরেনি।’suez canal 04

এইলাট রেলপথ

খাল তৈরির বিকল্প হিসেবে ইসরায়েল সরকার ২০১২ সালে লোহিত সাগরে এইলাট বন্দর থেকে ভূমধ্যসাগরে হাইফা বন্দর পর্যন্ত একটি রেললাইন প্রকল্প অনুমোদন করে। পরিকল্পনা ছিল এশিয়া থেকে জাহাজ এসে তাদের পণ্য এইলাটে খালাস করবে। তারপর পণ্য ট্রেনে করে হাইফায় নিয়ে ইউরোপগামী জাহাজে তোলা হবে। কিন্তু জাহাজ ব্যবসায়ীরা দুই বার মাল উঠানামার ঝামেলায় রাজি হবে কিনা এবং সেই সঙ্গে এইলাট বন্দর বাড়তি কর্মকাণ্ডের চাপ সহ্য করতে পারবে কি-না, সেই সন্দেহ থেকে ওই পরিকল্পনা চাপা পড়ে যায়।

সামি হামদি বলেন, আরব বসন্তের পর মিসরের আনুগত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের মধ্যে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এখন মিসরের যে সরকার, তারা আমেরিকার অনুগত। কিন্তু এই আনুগত্য কতদিন স্থায়ী হবে এবং ভবিষ্যতে সুয়েজ খালকে কায়রো কিভাবে ব্যবহার করবে তা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।’

এ কারণে ২০১৬ সালেও সুয়েজের বিকল্প পানিপথ তৈরি নিয়ে জোরেশোরে কথা উঠেছিল। কিন্তু ইয়েমেনের যুদ্ধ এবং মিসরের স্পর্শকাতরতার কথা বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি চাপা দিয়ে দেয়। এরপর ২০২০ সালে যখন সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক স্থাপন করে, তখন আবারও ইসরায়েলের ভেতর দিয়ে সুয়েজ খালের বিকল্প একটি খালের কথা উঠে।

সামি হামদি বলেন, ‘আমিরাত ওই খাল তৈরিতে বিনিয়োগ করার কথাও বলে। সঙ্গে সঙ্গে মিসরে লেখালেখি শুরু হয় যে, ইউএই এই বিনিয়োগ করলে তা বিশ্বাসঘাতকতার শামিল হবে। পরে আস্তে আস্তে চুপসে যায় আমিরাত।’

গত সপ্তাহে ছয় দিন ধরে সুয়েজ খাল বন্ধ থাকার পর আবার উঠতে শুরু করেছে বিকল্প খালের কথা। সামি হামদি-র মতে, ইসরায়েল হয়তো এখন মনে করছে এই পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক সমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতার যথার্থ সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তার ভাষায়, ‘পুরোপুরি ইসরায়েলের ভেতর দিয়ে না নিয়ে বরং মিসর-ইসরায়েল সীমান্ত দিয়ে বিকল্প একটি খাল কাটার যে কথা হচ্ছে সেটি হয়তো একটি আপোষ ফর্মুলা। আসলে মূল লক্ষ্য হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এই পানিপথটির ওপর মিসরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ খর্ব করা।’

সামি হামদি বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, সুয়েজের বিকল্প যে খাল ইসরায়েল চায় তার পেছনে অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করছে ইসরায়েলের ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ।’

বিকল্প খাল, মিসর ও আরব বিশ্ব

প্রশ্ন হচ্ছে, মিসর সুয়েজের বিকল্প কোনও খাল তৈরিতে রাজি হবে কি-না? সুয়েজ খাল থেকে বছরে মিসরের প্রায় ৬০০ কোটি ডলার আয় হয়, যা দেশটির জিডিপির দুই শতাংশের মতো। তবে সামি হামদি মনে করেন, মিসরের কাছে সুয়েজ খালের অর্থনৈতিক গুরুত্বই একমাত্র বিবেচ্য নয়। আঞ্চলিক ইস্যুতে প্রভাব তৈরির ক্ষেত্রে যতটুকু অস্ত্র দেশটির রয়েছে, সুয়েজ খাল তার অন্যতম। ওয়াশিংটন যেসব কারণে কায়রোকে গুরুত্ব দেয়, সেটির পেছনেও অন্যতম কারণ এই সুয়েজ খাল। সুতরাং বিকল্প একটি খাল এবং এই পানিপথের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া হবে মিসরের জন্য একটি বিপর্যয়। মধ্যপ্রাচ্যে কায়রোর প্রভাব ও গুরুত্ব দারুণভাবে মার খাবে।

এসব কারণেই গত সপ্তাহের সংকট দ্রুত নিরসনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল কায়রো। একাধিক দেশ থেকে রাতারাতি বিশেষজ্ঞ উড়িয়ে আনা হয়েছিল। সারাক্ষণই আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে তারা জানিয়েছে এবং দেখিয়েছে যে, কতটা গুরুত্ব দিয়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।

সামি হামদি মনে করেন, সুয়েজ খালের ওপর কায়রোর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে শুধু মিসর নয়, আমেরিকার ওপর চাপ তৈরির অবশিষ্ট যে গুটিকয় অস্ত্র আরব বিশ্বের রয়েছে, তাও ভোঁতা হয়ে যাবে। সূত্র: বিবিসি।