ফ্রান্স বনাম মরক্কো: ১১০ বছর ধরে চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা

কাতারে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে বুধবার রাতে মরক্কো মুখোমুখি হবে সাবেক উপনিবেশকারী ফ্রান্সের। বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রদর্শনী ম্যাচের বাইরে এই প্রথম দুই দল মুখোমুখি হবে। কিন্তু দেশ দুটির রয়েছে দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস এবং বর্তমান। যা ভূমধ্যসাগরে বিভক্ত দেশ দুটির সম্পর্কে সবসময় ছায়া ফেলছে।

ফ্রান্সের ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিস্টিকস অ্যান্ড ইকোনমিক স্টাডিজ-এর মতে, মরক্কো বংশোদ্ভূত ৭ লাখ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ বাস করছেন ফ্রান্সে। সাম্প্রতিক ভিসা বিরোধের ফলে মরক্কো থেকে ফ্রান্সে এসে আত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এই কঠোর ভিসা প্রক্রিয়া জারি করেছে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সরকার। বুধবারের সেমিফাইনাল দেখতে কাতারে গ্যালারিতে থাকতে পারেন তিনি।

মরক্কোতে ফ্রান্সের উপনিবেশ

প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলা মরক্কোর জন্য যদি অতিরিক্ত অনুপ্রেরণা প্রয়োজন হয়, তাহলে তাদের এক শতাব্দী পুরোনো ইতিহাসে নজর ফেরালেই হবে।

১৯১২ সালে মরক্কোর সুলতান আবদুল হাফিজের সঙ্গে ‘ট্রিটি অব ফেস’ স্বাক্ষর করে ফ্রান্স। যার ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে মরক্কো ফ্রান্সের প্রতিরক্ষার আওতায় চলে আসে এবং পরের বছরগুলোতে তারা সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মরক্কোর ৪০ হাজার সেনাকে ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীর হয়ে লড়াইয়ে পাঠায় ফ্রান্স।

ফ্রান্স ফেভারিট হলেও ইতিহাস গড়তে চায় মরক্কো। ছবি: রয়টার্স

কিন্তু ফ্রান্সের উপনিবেশবিরোধী মনোভাব মরক্কোর মানুষদের মধ্যে বাড়তে শুরু করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাপক রূপ নেয়। এই সময়ে ইউরোপের অনেক উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৪ সালে নতুন গঠিত ইস্তিকলাল পার্টি মরক্কোর স্বাধীনতার ঘোষণা জারি করে।  

১৯৫২ সালে ক্যাসাব্লাঙ্কায় উপনিবেশবিরোধী বিদ্রোহ সহিংস পন্থায় দমন করে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। ওই সময় মরক্কোর কমিউনিস্ট ও ইস্তিকলাল পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে সুলতান মোহাম্মদ পঞ্চমকে মাদাগাস্কারে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

এই পদক্ষেপগুলোর ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আরও জোরদার হয়। মোহাম্মদ পঞ্চমকে মরক্কো ফিরে আসার অনুমতি দেয় ফ্রান্স। ১৯৫৫ সালের ১৮ নভেম্বর মরক্কোর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন সুলতান এবং ১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণের অবসান হয়।

ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার

স্বাধীনতার পর মরক্কো একাধিক নীতি বাস্তবায়ন করে, যাতে ফ্রান্সের প্রভাব থেকে বের হওয়া যায়। একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা হয়।

১৯৭৩ সালে বাদশাহ হাসান দ্বিতীয় একাধিক অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। এতে বেসরকারি খাতে ৫০ শতাংশের বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। এগুলোর বেশিরভাগের মালিকানা ছিল ফ্রান্সের।

আশির দশকে বাদশাহ বাস্তবায়ন করেন আরবিকরণ নীতি। এর আওতায় দেশটির স্কুল ব্যবস্থা ফরাসি ভাষার বদলে আরবিতে চালু হয়। ত্রিশ বছর পর এই নীতি সংশোধন করে মাধ্যমিক স্কুলের গণিত, বিজ্ঞান ও পদার্থ বিষয়ের জন্য ফরাসি ভাষায় শিক্ষাদানে ফিরে যাওয়া হয়।

ফ্রান্স এখনও মরক্কোর প্রধান বিদেশি বিনিয়োগকারী, বাণিজ্যিক অংশীদার। ফলে দেশ দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে।

মরক্কো সফরে সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি। ছবি: রয়টার্স

২০০৭ সালে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি মরক্কো সফর করেন। আর বোরাক নামের দ্রুতগতির ট্রেন সেবার কাজ পরিদর্শন করেন তিনি। এই প্রকল্পে ৫১ শতাংশ অর্থায়ন করে ফ্রান্স।

দুই মাস আগে মরক্কো ও ফ্রান্স একটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলে ফ্রান্সে। ওই ম্যাচ ২-২ গোলে ড্র হয়েছিল।

২০১৪ সাল থেকে দুই দেশের সম্পর্কে জটিলতা বাড়তে শুরু করে। মরক্কোর অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আব্দেললতিফ হামৌচিকে ফ্রান্স জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছিল। এর ফলে মরক্কো দেশটির সঙ্গে বিচারিক সহযোগিতা স্থগিত করে। এক বছর পর কূটনৈতিক উত্তেজনা নিরসন হয় এবং দেশ দুটি পুনরায় সহযোগিতায় ফিরে।

২০১৮ সালে বাদশাহ মোহাম্মদ ষষ্ঠ ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একটি নতুন উচ্চগতির ট্রেনের উদ্বোধনী সফরে ছিলেন একসঙ্গে।  

জটিলতা

বিভিন্ন সময় দেশ দুটির সম্পর্কে উত্থান-পতন ছিল। এই বছরের শুরুতে পশ্চিম সাহারাকে মরক্কো নিজের অংশ বলে যে দাবি করে আসছে, সেটির প্রতি সমর্থন জানান ম্যাক্রোঁ। পশ্চিম সাহারার পোলিসারিও ফ্রন্ট দীর্ঘদিন ধরে মরক্কোর কাছ থেকে স্বাধীনতা দাবি করে আসছে।

প্যারিসে মরক্কোর জয় উদযাপন আলজেরীয়দের। ছবি: রয়টার্স

ম্যাক্রোঁর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিতর্কিত অঞ্চলের ওপর মরক্কোর মালিকানাকে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই অবস্থান বদলে ফেলেছেন।

কিন্তু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সম্পর্কে আবারও জটিলতা দেখা দেয়। ওই সময় ফরাসি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, মরক্কো ও আলজেরিয়ার নাগরিকদের ভিসা প্রদানের হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা হবে।

ফরাসি সরকার বলছে, উত্তর আফ্রিকার সরকারগুলো নিজেদের রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

মরক্কোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসের বৌরিটা এই পদক্ষেপকে ‘অন্যায্য’ বলে উল্লেখ করেছেন।

ফ্রান্স ও মরক্কো পরস্পরের সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবন করে, এটি স্পষ্ট। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মরক্কো সফরের পরিকল্পনা রয়েছে ম্যাক্রোঁর। কিন্তু এর আগে ঐতিহাসিক বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দুই দল মুখোমুখি হচ্ছে।

ইতিহাস যদি পদনির্দেশক হয়, তাহলে কোনও পক্ষের জন্য ম্যাচটি সহজ হবে না।

সূত্র: আল জাজিরা