জাতিসংঘে সাংবাদিকদের পার্শ্ব বৈঠকে মানবাধিকার হরণ নিয়ে উদ্বেগ

নিয়মিত হুমকি, হামলা ও হত্যা ছাড়াও বিশ্বের নানা প্রান্তে কারাবন্দি হচ্ছেন রেকর্ড সংখ্যক সাংবাদিক। শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের এক পার্শ্ববৈঠকের আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব ঘটনা শুধু সাংবাদিকদের মৌলিক মানবাধিকারই হরণ করছে তা নয় বরং এতে মানুষের তথ্য পাওয়া ও জানানোর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সাংবাদিক সুরক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) এই পার্শ্ববৈঠকের আয়োজন করে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পক্ষে সরব ভূমিকা রেখে থাকে।

image1170x530cropped

অলাভজনক সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ ২৬২ জন সাংবাদিক কারাবন্দি ছিলেন। এর মধ্যে তুরস্কে ৭০ জন, চীনে ৪০ জন ও মিসরে ২০ জন ছিলেন। সিপিজে বলছে, কারাবন্দি এসব সাংবাদিকদের ৫২ শতাংশই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রতিবেদন করার কারণেই কারারুদ্ধ ছিলেন।

২০১৮ সালের মে মাসে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিনা বিচারে সাংবাদিকদের কারাবন্দি রাখার ফলে ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ উস্কানি পাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক নিরাপত্তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইউনেস্কোর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এসব কারণে মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, এসব ঘটনা বাড়ছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে।  অনেক সরকার বিশেষ সাংবাদিকদের তাদের কাজ সংশ্লিষ্ট বিষয় বহির্ভুত কারণেও আটক রাখছে।

সিপেজের নির্বাহী পরিালক জোয়েল সিমন বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন সরকার নিয়মিতভাবে জরুরি আইন ব্যবহার করে সংবাদমাধ্যম ও প্রকাশনা সেন্সর করছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘ফেইক নিউজ’র অভিযোগ তোলার ঘটনাও বাড়ছে যা তাদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতির সঙ্গে মিলছে না। তারা সাংবাদিকদের সামরিক আদালতে বিচারের চেষ্টা করছে এমনকি অনির্দিষ্ট সময় ধরে তাদের প্রাক-বিচারিক সময়ে আটক রাখছে। তিনি বলেন, এসব কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও জাতিসংঘের নির্ধারণ করে দেওয়া মানের বিরোধী।

মানবাধিকারের বিশ্বজনীন ঘোষণার ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে কোনও ধরণের হস্তক্ষেপ ছাড়াই মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্য খোঁজা ও জানানোর নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে এসব তথ্য যেকোনও মাধ্যমে নির্বিশেষ সীমানায় প্রকাশ করার নিশ্চয়তা রাখা হয়েছে। ১৯৬৬ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তিতে এই বিশ্বজনীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন ২ নভেম্বরকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তি বন্ধের আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

শুক্রবার জাতিসংঘ সদর দফতরে আয়োজিত পার্শ্ববৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের কারাবন্দি রাখার নির্দিষ্ট পাঁচটি ঘটনা গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে, মিসরের আলা আবদেল ফাত্তাহ, কিরগিজস্তানের আজিমজন আস্কারভ। এই দুই সাংবাদিকই নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা মানবাধিকার হরণের অভিযোগের খবর প্রকাশ করেছিলেন। আলোচনায় ছিলেন ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনা কাভার করা বাংলাদেশের আলোকচিত্রী শহিদুল আলমও। এছাড়া রোহিঙ্গা গণহত্যার তথ্য সংগ্রহের সময় মিয়ানমারে আটকের পর সাত বছরের কারাদণ্ড পাওয়া রয়টার্সের দুই সাংবাদিকও ছিলেন আলোচনায়।

জাতিসংঘ সদর দফতরের ওই বৈঠকে বিশ্বের সুপরিচিত মানবাধিকার আইনজীবী এবং কারাবন্দি রয়টার্স সাংবাদিকদের আইনি উপদেষ্টা অমল ক্লুনি বলেন, ‘তাদের দোষী সাব্যস্ত করা এবং সাত বছরের দণ্ড ঘোষণা ন্যায়বিচারকে উপহাস করার সমতুল্য। আর তাদের মুক্তি দেওয়া সরকারের ওপর নির্ভর করে।’

এই মাসের শুরুর দিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মিশেল ব্লাচেট এক বিবৃতিতে বলেছেন, ওই দুই সাংবাদিকের গণহত্যার কাভারেজে সামরিক বাহিনীর দায় দায়িত্ব উঠে এসেছে। যা পরিষ্কারভাবে মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আর এটি না হলে কখনওই তা প্রকাশ্যে আসতো না। তাদের দণ্ড বাতিলের আহ্বান জানিয়ে তিনি তাদের মুক্তি দিতে মিয়ানমার সরকারকে অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে তিনি মত প্রকাশের অধিকার রক্ষার কারণে আইনি ব্যবস্থার ফাঁদে যারাই আটক রয়েছেন তাদরে সবার মুক্তির দাবি করেন তিনি।

জাতিসংঘ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, সাংবাদিকদের বৈধ কাজের জন্য কারাবন্দির ঘটনা শুধু সেল্ফ সেন্সরকেই উৎসাহিত তরছে তা নয় বরং এতে বৃহত্তর অর্থে সমাজের তথ্য প্রাপ্তির অধিকারও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।