১৫ মাসে ১৫ কেজি ওজন কমানোর ওষুধে সাফল্য দাবি বিজ্ঞানীদের

নতুন একটি ওষুধ ক্ষুধা দমন করে ব্যাপকভাবে স্থূলতা কমানোয় সফল বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় ধরনের এক ট্রায়াল চালিয়ে তারা দেখেছেন, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া অনেকেই তাদের ওজন ১৫ মাসে গড়ে ১৫ কেজি কমিয়ে ফেলতে সফল হয়েছেন।

প্রায় দুই হাজার মানুষের ওপর এই ট্রায়াল চালানো হয়। তাদের প্রতি সপ্তাহে একবার সেমাগ্লুটাইড নামে এই ওষুধ ইনজেকশন হিসেবে দেওয়া হয়। পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস ও শরীর সুস্থ রাখার বিষয়ে তাদের নানা পরামর্শও দেওয়া হয়।

১৫ মাসের ট্রায়ালে তাদের গড়ে ১৫ কেজি করে ওজন কমেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ট্রায়ালের ফলাফল থেকে তারা মনে করছেন, স্থূলতার চিকিৎসায় এই ওষুধ একটা 'নতুন যুগের' সূচনা করবে।

ট্রায়ালে অংশ নেওয়া যুক্তরাজ্যের কেন্ট অঞ্চলের জ্যান এই পরীক্ষায় ২৮ কেজি ওজন কমিয়েছেন যা তার শরীরের ওজনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। তিনি বলেন, ‘এই ওষুধ আমার জীবন বদলে দিয়েছে। খাবারের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিও পুরো বদলে গেছে।’

তিনি বলেন, আগে তিনি ডায়েট করে অর্থাৎ খাওয়া কমিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছিলেন, যা ছিল খুবই কষ্টকর। কিন্তু এই ওষুধ নেওয়ার অভিজ্ঞতা একদম আলাদা। কারণ এই ইনজেকশন নেওয়ার পর তার ক্ষুধা পেতো কম।

কষ্টকর ছিল না

ট্রায়াল শেষ হওয়ার পর জ্যানের আগের মতো আবার ক্ষুধা বেড়ে গেছে এবং আবার তার ওজন বাড়ছে। তিনি বলছেন, ‘ট্রায়ালের সময় ওজন কমানোর ব্যাপারটা মোটেও কষ্টকর ছিল না। এখন আবার ক্ষুধার সঙ্গে সার্বক্ষণিক লড়াই করতে হচ্ছে।’

যারা টাইপ-টু ডায়বেটিসের চিকিৎসা নেন তাদের অনেকের কাছেই সেমাগ্লুটাইড একটি পরিচিত নাম। কিন্তু ওজন কমানোর এই ট্রায়ালে ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়েছে আরও বেশি ডোজের।

এই ওষুধ কাজ করে শরীরে ক্ষুধার প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। পেট ভরে খাওয়ার পর শরীরের ভেতর জিএলপি১ নামে যে হরমোন নিঃসরণ হয়, এই ওষুধ ঠিক সেই হরমোনের অনুভূতি শরীরে তৈরি করে। ফলে সবসময়ই মনে হয় পেট ভরা আছে।

ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কয়েকজনকে এই ওষুধ দেওয়া হয় এবং কয়েকজনকে ওষুধ নেই এমন তরল পদার্থের ইনজেকশন দেওয়া হয়। এদের সবাইকেই খাবার ও জীবনযাপন বদলানোর ব্যাপারে একই পরামর্শ দেওয়া হয়।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন নামে এক সাময়িকীতে ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, সেমাগ্লুটাইড ওষুধ নেওয়া ব্যক্তিদের ওজন কমেছে গড়ে ১৫ কেজি। আর যাদের ওষুধ দেওয়া হয়নি, তাদের ওজন কমেছে গড়ে ২ দশমিক ৬ কেজি।

ওষুধ যাদের দেওয়া হয়েছে তাদের ৩২ শতাংশই পাঁচ ভাগের এক ভাগ ওজন কমাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যাদের ওষুধ দেওয়া হয়নি তাদের ২ শতাংশেরও কম ব্যক্তির ওজনে কোনও হেরফের হয়নি।

নতুন যুগ

গবেষক দলের একজন সদস্য ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক রেচেল ব্যাটারহাম। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এই ওষুধ যে পরিমাণ ওজন সফলভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছে, তাতে এটা স্থূলতার চিকিৎসায় নতুন যুগের সূচনা করবে।’

তিনি বলেন, ‘স্থূলতার সমস্যা নিয়ে আমি গত ২০ বছর ধরে গবেষণা করছি। এ যাবত একমাত্র পরিপাকতন্ত্রে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্থূলতা কমাতে কোনও চিকিৎসাই কার্যকর হয়নি।’

তিনি বলছেন, ওজন কমালে হৃদযন্ত্রের অসুখ, ডায়বেটিস এমনকি কোভিড-১৯ এর জটিলতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সেমাগ্লুটাইড ওষুধটি এখন ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমোদনের জন্য পেশ করা হচ্ছে।

অধ্যাপক ব্যাটারহাম বলছেন, এই ওষুধ প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু স্থূলতার চিকিৎসা বিষয়ক বিশেষ ক্লিনিকগুলোতে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন করা হবে। ঢালাওভাবে ব্যবহারের জন্য তা বাজারে ছাড়া হবে না। কারণ এর কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন বমিভাব, ডায়রিয়া, বমি হওয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য। এছাড়াও তারা পাঁচ বছরব্যাপী একটি গবেষণা চালাবেন দেখার জন্য যে এই ওষুধ ব্যবহার করে ওজন কমানোর ব্যাপারটা দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হবে কিনা।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিজ্ঞানী অধ্যাপক সার স্টিফেন ও'রাহিলি বলছেন, ‘এই ওষুধ ব্যবহার করে যে পরিমাণ ওজন কমানো সম্ভব হয়েছে, তা স্থূলতা কমানোর জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত বর্তমান যে কোনও ওষুধের থেকে বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। স্থূলতার চিকিৎসার জন্য ভবিষ্যতে ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সেমাগ্লুটাইড একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিতে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখন ওজন কমাতে একই ধরনের এমন ওষুধ আবিষ্কারে উদ্যোগী হতে পারব্নে যা সমানভাবে কাজ করবে, কিন্তু তাতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকবে না।’

পুষ্টিবিদ ড. ডুয়ান মেলর বলছেন, বিশাল ওজন যাদের জন্য বড় সমস্যা তাদের চিকিৎসার জন্য কার্যকর ওষুধ ব্যবহারের সুযোগ অবশ্যই সুখবর। তবে পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জীবনযাপনের ধারা এবং খাদ্যাভ্যাস ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওষুধ এবং জীবনযাপনের ধারা বদলানোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং ঝুঁকিও যে থাকে সেটাও মাথায় রাখা দরকার। আর তাই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ওজন কমানোর চিকিৎসা শুরু করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সূত্র: বিবিসি।