ট্রাম্প-নেতানিয়াহুকে ‘শান্তির শত্রু’ আখ্যা

ক্রমেই জোরালো হচ্ছে মার্কিন ইহুদিদের ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান

বিশ্ববিবেকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ইসরায়েলের ফিলিস্তিন-নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন মার্কিন ইহুদিরা। ট্রাম্প-নেতানিয়াহুকে মধ্যপ্রাচ্যের ‘শান্তির শত্রু’ আখ্যা দিয়ে জায়নবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছেন তারা। উদার ইহুদি সংগঠনগুলো ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও ফিলিস্তিনিদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পথে পথে প্রতিবাদে নেমেছে। ৪ বছর আগের এক জরিপে আভাস মিলেছিল, মার্কিন ইহুদিদের মাত্র ৩৮ শতাংশ ইসরায়েলি নীতি সমর্থন করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেই সমর্থন ক্রমেই আরও কমে আসছে। বিপরীতে জোরালো ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান নিয়ে সংগঠিত হচ্ছে মার্কিন ইহুদিরা।

qw

ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল নামের রাষ্ট্র। ১৯৭৬ সালের ৩০ মার্চ ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ইহুদি বসতি নির্মাণের প্রতিবাদ করায় ছয় ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। পরের বছর থেকেই ৩০ মার্চ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পরবর্তী ছয় সপ্তাহকে ভূমি দিবস হিসেবে পালন করে আসছে ফিলিস্তিনিরা। এবারের কর্মসূচির শেষ ২ দিনে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ জোরালো হয়ে উঠলে ৬০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। কেবল সোমবারের বিক্ষোভেই ৫৮ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। আহত হয় ২৭০০ মুক্তিকামী। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ইফনটনাউ, জেউইশ ভয়েস ফর পিস, জে স্ট্রিট, জিউস ফর রেসিয়াল এন্ড ইকোনোমিক জাস্টিসসহ বিভিন্ন উদার ইহুদি সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় রাস্তায় আন্দোলন করছে।
nonameগত বছরের ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের একক রাজধানীর স্বীকৃতি দেন। এর বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে তুমুল নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়ে শামিল হন ইহুদি ধর্মাবলম্বী হলিউড তারকারাও। সোমবারের সহিংসতার আগেই গত মাসে ‘জেনেসিস প্রাইজ’ গ্রহণে ইসরায়েল যাওয়ার কথা থাকলেও তাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন নাটালি পোটর্ম্যান। তিনি বলেছিলেন, সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলি খুবই হতাশ করেছে তাকে। সোমবারের ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে কমেডিয়ান সারাহ সিলভারম্যান এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ইহুদিদের এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা উচিত।’
noname

ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, তারা গাজার উগ্র ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে তাদের নাগরিককে রক্ষা করছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালিসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য কর্মকর্তার নীতিগত অবস্থানও একই ধরনের। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সাধারণ ইহুদিদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম। ইফনটনাউ সংগঠনের মুখপাত্র এথান মিলার বলেন, ‘আমাদের নাম করে সহিংসতা করা হচ্ছে। সেই হত্যাযজ্ঞে নিহত হয়েছে অর্ধশতাধিক। আমরা চুপ বসে থাকতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সংগঠিত প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে জানাতে চাই, আমরা কোনোভাবেই এই দখলদারিত্বের পক্ষে নই। আমরা এর বিরুদ্ধে।’

noname
গত বছরের ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের একক রাজধানীর স্বীকৃতি দেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বজুড়ে তুমুল নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উপেক্ষা করে সোমবার জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর করে যুক্তরাষ্ট্র। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইফনটনাউ সংগঠনের ব্যানারে ১শ’ ইহুদি ঘটনার প্রতিবাদে ওয়াশিংটনের ট্রাম্প টাওয়ার সংলগ্ন রাস্তা আটকে ২ ঘণ্টা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। ‘সহিংসতা বন্ধ করো’, ‘ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার মধ্যেই ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ নিহিত’, ‘আমরা একটি ভালোবাসার বিশ্ব গড়তে চাই’ লেখা টি শার্ট পরে বিক্ষোভে অংশ নেন তারা। তারা দাবি তোলেন দখলদারিত্বের দূতাবাসের বিপরীতে একটি স্বাধীনতার দূতাবাস প্রতিষ্ঠার। এদিকে মার্চের শেষদিকে দেশজুড়ে ৪৫টি আন্দোলন করতে সাহায্য করেছে জেউেইশ ভয়েস ফর পিস।
সোমবার নিউ হ্যাভেন, কানেকটিকাট, মন্টচেয়ার নিউ জার্সি, ফিলাডেলফিয়া, বোস্টন, ওহাইও, ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কেও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে তারা। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রেবেকা ভিকোমারসন জেরুজালেমে দূতাবাস উদ্বোধনের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিলো এদিনটা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সম্পর্কে ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে দিন। লজ্জার দিন। ফিলিস্তিনিরা যখন তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হচ্ছে তখন ইসরায়েল অনুষ্ঠান করছে। এটা সত্যি লজ্জার। রেবেকা বলেন, ‘আমাদের নাম নিয়ে যা করা হচ্ছে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’

noname

উল্লেখ্য, ইহুদি ধর্মের নামে ‘জায়নবাদ’-এর মধ্য দিয়েই ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসরায়েল রাষ্ট্র। জায়নবাদ ইহুদি ধর্মের দর্শন নয়, এটি একটি রাজনৈতিক মতবাদ; অলীক রূপকথায় যে মতবাদের শরীর গড়ে উঠেছে। জায়নবাদের ভাষ্য, জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত পবিত্র নগরীতে স্রষ্টা তাদের অধিকার ফিরিয়ে নিতে বলেছিল! ইতিহাসে নজর ফেরালে দেখা যায়, ১৮ শতক থেকে জায়নবাদ নামের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইউরোপসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা তাদের বর্ণবাদী ধারণার বিস্তার ঘটিয়ে দখল হওয়া ফিলিস্তিন ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম দেন। জায়নবাদের মাধ্যমে তখন থেকে আজ পর্যন্ত ইহুদি জনগণের মনে ফিলিস্তিনবিরোধী বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান।

২০১৩ সালে করা পিউ রিসার্চের এক জরিপ বলছে, গত এক দশকে মার্কিন ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের জায়নবাদী নীতির বিরুদ্ধে ক্রমেই অবস্থান জোরালো করছে। মাত্র ৩৮ শতাংশ মার্কিন ইহুদি মনে করেন ফিলিস্তিনের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা নিচ্ছে ইসরায়েল। আর চলতি বছরে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইসরায়েলি নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন ইহুদিরা ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠছেন। তারা মনে করছেন, দখলদারিত্ব আর হত্যাযজ্ঞের কারণে খোদ তাদের ধর্ম নিয়ে বিশ্ববাসীর নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করছে। তারা কমবেশি সবাই মনে করছেন, ট্রাম্প-নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি বিঘ্নিত করে চলেছেন।

noname

দ্য ফেইলার অব দ্য আমেরিকান জিউশ এস্টাবলিশমেন্ট শীর্ষক প্রবন্ধের লেখক পিটার বেনার্ট বলেন, ‘কয়েক দশক ধরে জিউশ এস্টাবলিশমেন্ট মার্কিন ইহুদিদের উদারপন্থা ত্যাগ করে জায়নবাদের পথে আসতে প্ররোচিত করেছে। তবে এখন দেখা যাচ্ছে, সেই জিউশ এস্টাবলিশমেন্ট-এর পক্ষের তরুণদের মধ্যেও জায়নবাদবিরোধী অবস্থানই দিনকে দিন প্রবল হচ্ছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থী ইহুদিদের সংগঠনগুলো ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, তারা জায়নবাদের সমর্থক মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈরিতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন প্রায়শই। রেবেকা বলেন, ‘প্রায়ই আমাদের মতো সংগঠনকে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো চাপ দেয়। কারণ, আমরা ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলি। অনেকে ইসরায়েলের এমন আচরণে নিজেদের ইহুদি ধর্মের উদারবাদী আলো থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে আবার তাদের উদারবাদী ইহুদি চৈতন্যের পথে ফেরানোর চেষ্টা করছি।’