‘আমার মেয়ে চিকিৎসকদের অবহেলার শিকার’

অজানা রোগে আক্রান্ত মুক্তামনি দীর্ঘদিন ধরে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করছে। মেয়ের এ কষ্টের জন্য চিকিৎসকদের অবহেলাকেই দায়ী করলেন তার বাবা ইব্রাহীম হোসেন। মঙ্গলবার (১১ জুলাই) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) বার্ন ইউনিটে মেয়ের পাশে বসে ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ‘আমার মেয়ে এতদিন চিকিৎসকদের অবহেলার শিকার হয়েছে। গত কয়েক বছরে যত ডাক্তারের কাছে গিয়েছি, তাদের বেশিরভাগই মেয়েটাকে ঠিকমতো দেখতেও আগ্রহী হতেন না। মেয়েটা যদি সঠিক চিকিৎসা পেতো তাহলে রোগটা এত বেশি হতো না, মেয়েটা এত কষ্টও পেতো না। তিন বছর আগে খুলনার এক ডাক্তার বলেছেন, ‘আপনার বাচ্চার ক্যান্সার, বেশিদিন আয়ু নাই, ফাও ট্রিটমেন্ট করাইয়েন না।’

বাবা ও মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে মুক্তামনি

সাতক্ষীরার কামারপাশা গ্রামের মুদি দোকানি ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ‘ডাক্তারের এই কথা শুনে মেয়ের চিকিৎসাটা বন্ধ রাখছিলাম। কিন্তু সেই ডাক্তারের বলা ১৫ দিন যেতে যেতে যখন আজ  তিন বছর পার হলো, তখন আবার মেয়েটাকে নিয়ে আশার আলো দেখছি; আমার আর কিছু চাওয়ার নেই, আল্লাহ যেন আমার মেয়েটাকে সুস্থ করে তোলেন।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে ইব্রাহীম হোসেনের, চোখ মুছতে মুছতে তিনি পাশে শুয়ে থাকা মুক্তামনির মাথায় হাত রাখেন। ‘অবহেলার শিকার’ আশামনি এখন চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছে ঢামেকে। তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী। ছোট্ট মেয়েটি আবার সুস্থ হয়ে উঠবে এমন আশা এখন করতেই পারেন ইব্রাহীম হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাংলা ট্রিবিউন আমার মেয়ের খবরটি প্রকাশ করল,তারপর আমরা আজ  এখানে।’

মুক্তামনিকে ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ সাতক্ষীরা ও খুলনার নানা হাসপাতালের চিকিৎসকদের দেখিয়েছিলেন ইব্রাহীম হোসেন। কিন্তু চিকিৎসার পরিবর্তে হতাশ হতে হয়েছে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তিনি বলেন, ‘এখন আর আমি হতাশ নই, দেরিতে হলেও ঠিক জায়গায় আমি আসতে পেরেছি, এটাই এখন সান্ত্বনা।’ সাতক্ষীরা থেকে সোমবার (১০ জুলাই) রাতে মুক্তামনির পরিবার ঢাকায় এলে মঙ্গলবার সকালেই তাকে ভর্তি করা হয়। তার চিকিৎসায় ইতোমধ্যেই ৮ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। মুক্তামনি কী রোগে আক্রান্ত তা বুধবার (১২ জুলাই) নাগাদ জানা যাবে বলে জানিয়েছেন বার্ন ইউনিটের সম্বন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। মঙ্গলবারই শিশুটির চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিরল এক রোগে আক্রান্ত হয়ে ১১ বছরের মুক্তামনি এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি আছে। তার এক হাত ফুলে গিয়ে দেহের চেয়েও ভারী হয়ে গেছে। সাদা রঙের শত শত পোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই ফুলে যাওয়া অংশে। চার বছর ধরে এই ‘বোঝা’ বয়ে বেড়াচ্ছে ছোট্ট শিশুটি। শরীরের অসহ্য ব্যথা ও যন্ত্রণায় খেলাধুলা তো দূরের কথা, ঠিকমতো বসতেও পারে না মুক্তামনি। স্কুলেও যাওয়া হয় না তার।

মুক্তামনি বার্ন ইউনিটে ভর্তি হওয়ার পর মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দুই বেডের একটি কেবিনের এক বেডে মুক্তামনি শুয়ে শুয়ে পরোটা দিয়ে ডাল খাচ্ছে। তার গায়ে একটি কাঁথা জড়ানো। কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালে আসার ধকল পরিবারটি তখনও সামলে উঠতে পারেনি। মুক্তার সঙ্গে হাসপাতালে এসেছেন তার বাবা ইব্রাহীম হোসেন, মা আছিয়া খাতুন, চাচা আহসান হাবীব, মুক্তামনির জমজ বোন হীরামনি ও দেড় বছর বয়সী ছোট ভাইটি। ‘পুরো পরিবার চলে এসেছেন’ বলতেই মুক্তামনির চাচা আহসান হাবীব বলেন, ‘এই পুরো পরিবারটি বিগত বছরগুলোতে মুক্তার পাশেই রয়েছে আপা।’

মুক্তামনি কবে থেকে এই রোগে আক্রান্ত জানতে চাইলে তার বাবা ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ‘জন্মের দেড় বছর পরপরই তার ডান হাতের কুনইয়ের উপরের অংশে চামড়ার নিচে এক ধরনের গোটা হয়।তখন থেকেই ডাক্তারদের কাছে ঘুরছি। প্রথমে সাতক্ষীরার এক চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি হাড়ে টিউমার হয়েছে বলে জানান। তার ওষুধ খাওয়ালে গোটা কমে যায়, আবার হয়। এরপর গেলাম সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে। সেখান থেকে খুলনা হাসপাতাল। খুলনায় এক্সরে করার পর তারা বলে হাড়ে ইনফেকশন। ওষুধ খাওয়ার পরও কোনও উন্নতি না হওয়াতে যশোর যাই। সেখানে চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ খাওয়ানোর পর চামড়ার নিচের গোটা আর দেখা যায় না। কিন্তু একমাস পর আবার গোটা দেখা গেলে ফের হাসপাতালে যাই। ঢাকা থেকে তখন একজন অর্থোপেডিকসের চিকিৎসক যান যশোরের মা ও শিশু হাসপাতালে। তিনি বলেন, ‘এই বাচ্চার বুকের নিচের হাড়ে গোটা, পিঠে গোটা, হাতে গোটা-অপারেশন কয় জায়গায় করব।’ ইব্রাহীম হোসেন বলেন, এই কয়েক বছরে ডাক্তারদের কী পরিমাণ অবহেলা যে আমদের দেখতে হয়েছে। যেখানে গেছি সেখানেই আমরা অবহেলিত হয়েছি।’ ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ‘আমার নিজের স্পাইনাল কর্ডের সমস্যা ছিল, কিন্তু মেয়েটার জন্যই হয়তো আল্লাহ আমাকে সুস্থ করেছেন।’ এসময় পাশ থেকে মুক্তামনি বলে ওঠে, ‘আব্বু যদি সুস্থ না হতো, তাহলে আমারে দেখতো কে?’

মুক্তামনিকে সাভারের সিআরপি, ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েও নিয়ে গেছেন ইব্রাহীম হোসেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা ঘুরে খুলনার আদদ্বীন হাসপাতালে গেলে সেখানকার একজন ডাক্তার বলেন, “বাচ্চার ক্যান্সার, বেশিদিন আয়ু নাই, ফাও ট্রিটমেন্ট করাইয়েন না।” তারপর থেকেই ডাক্তারদের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দেই। কারণ, মেয়েটাকে নিয়ে ঘুরলে তারও খুব কষ্ট হতো। ভেবেছি, যে কটা দিন  বাঁচে, মেয়েটা যেন কষ্ট না পায়। তারপর কতশত হোমিওপ্যাথি আর কবিরাজের ওষুধ খাইয়েছি, তার ঠিক নেই। কিন্তু এরই মধ্যে মেয়েটার হাতের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। বাসা বেঁধেছে পোকা। হাত শরীরের চেয়েও ভারী হয়ে উঠেছে।’

মেয়েকে এভাবে দেখে কী ভাবতেন জানতে চাইলে মু্ক্তামনির মা আছমা খাতুন বলেন, ‘এত বছর ধরে দেখতে দেখতে এখন আর কিছু মনে হয় না, এটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে।’ পাশে থাকা মুক্তামনির জমজ বোন হীরামনি বলে, ‘আমাদের টিভি ছিল না। কিন্তু বোনের সময় কাটে না, খালি কান্না করে- এজন্য আব্বু টিভি কিনে দিছে। ওর জন্য আমার খুব কষ্ট হয়, আপনারা আমার বোনটারে ভালো কইরা দেন।’

এদিকে, এতোগুলো বছর ধরে মুক্তামনি সঠিক চিকিৎসা পায়নি বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন ঢামেক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৭ সালে এসেও একটি মেয়ে এভাবে চিকিৎসার অভাবে পড়ে আছে, এটা ভেবে আমি যারপরনাই বিস্মিত, এটা কী করে হতে পারে।’ মেয়েটির সুস্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘মুক্তামনি রক্তশূন্যতা ও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তাকে রক্ত ও পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। তাকে অপারেশনের জন্যে উপযুক্ত করতে দুই-তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে আমরা হতাশ নই, দেখা যাক কী হয়।’

/জেএ/এএম/