সারাবিশ্বের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ বছর আগেও বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার ছিল বেশি। এর অন্যতম কারণ ছিল প্রসব পরবর্তী রক্তপাত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয়, ‘পোস্ট পারটাম হেমোরেজ’ বা পিপিএইচ। দেশে কয়েক বছর আগেও এই চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু এটাকেই হাতের নাগালে নিয়ে আসেন ডা. সায়েবা আখতার। প্রসবকালীন রক্তপাত বন্ধে এই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ‘কনডম ক্যাথেটার টেম্পোনেড’ ব্যবহারের মাধ্যমে এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যা বিশ্বব্যাপী সায়েবা’স মেথড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এটি তার নামেই নিবন্ধিত। অথচ সম্প্রতি এই পদ্ধতি আবিষ্কারের অর্জনের কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে আরেক দেশকে। এটাকে গণমাধ্যমের ব্যর্থতা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০০০ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের গাইনি ও অবস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন ডা. সায়েবা। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে তিনি দেখছিলেন, প্রসব পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা যাচ্ছেন মায়েরা। এছাড়া জরায়ু কেটে ফেলতে হয় বলে পরবর্তীতে মা হওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হন অনেকে।
অতীতের স্মৃতি হাতড়ে ডা. সায়েবা বলেন, “একদিন আমার সামনেই দু’জন মা প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণে মারা যান, কারণ তাদের রক্তক্ষরণ থামানো যায়নি। তখন আমার মনে হলো, গ্রামে শিশুরা বেলুন ফুলিয়ে খেলে, সেই বেলুনের মধ্যে যদি পানি ঢুকিয়ে জরায়ুতে দেওয়া যায় তাহলে কী মায়েদের বাঁচানো যাবে কিনা। কারণ রক্তচাপ বন্ধে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে জরায়ুতে চাপ দেওয়া। কিন্তু রক্তপাত হওয়ার সময় চাপ দেওয়া যায় না।”
প্রশংসিত এই অধ্যাপকের ভাষ্য, “পরের দিনই হাসপাতালে গিয়ে দেখি, রক্তপাত থামাতে না পেরে এক নারীর জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসকরা। তাদের আমি থামালাম। চিকিৎসকদের বললাম, ইউটেরাস ফেলো না এখনই। একটু সময় দাও আমাকে। কারণ রক্তপাত বন্ধের প্রধান উপায় হচ্ছে চাপ দেওয়া। কোনোভাবে জরায়ুর ভেতরে কিছু দিয়ে চাপ দিলে রক্তপাত বন্ধ হবে। সেই প্রথম ‘কনডম ক্যাথেটার টেম্পোনেড’ ব্যবহার করলাম এবং ১০ মিনিটের মধ্যে তার রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়।”
এরপর অন্যান্য সহকর্মীকে নিয়ে ২৩ জন রোগীকে এই চিকিৎসা দেন ডা. সায়েবা। তাদের প্রত্যেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন বলেও জানান তিনি। তারপর থেকে এই আবিষ্কারের ফলে উপকৃত হয়েছেন লাখো প্রসূতি মা।
পদ্ধতিটি কীভাবে কাজ করে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখতার বাংলা ট্রিবিউনকে জানান— একটি ক্যাথেটার (প্রস্রাবের রাস্তার নল), একটি কনডম, একটু সুতা, একটি স্যালাইন সেট এবং একটি স্যালাইন দরকার হয়। ক্যাথেটারের মাথায় কনডমটি সুতা দিয়ে প্যাঁচিয়ে লাগিয়ে ক্যাথেটারের অন্য মাথায় স্যালাইন সেটের মাধ্যমে লাগানো হয় স্যালাইন। তারপর কনডমযুক্ত ক্যাথেটারের মাথা প্রসবকারী নারীর জরায়ুতে ঢুকিয়ে জরায়ুর ভেতরে কনডমটি ফুলিয়ে দেওয়া হয়। ফলে কনডমটি জরায়ুর ভেতরে ফুলে জরায়ুগোত্রে চাপ দেয় এবং এই চাপের কারণেই জরায়ুর ভেতর থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়।
অধ্যাপক ডা. সায়েবা আরও বলেন, ‘হাত-পা কিংবা শরীরের কোথাও কেটে গেলে সেখানে চাপ দিয়ে ধরলে যেমন রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়, ঠিক সেই একই পদ্ধতিতে এই মেথড কাজ করে। আমাদের দেশে শতকরা ৩১ শতাংশ মাতৃমৃত্যু হয় এই প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণে, কিন্তু এ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে তা অনেকটাই কমে এসেছে। মাত্র ১০০ টাকার মধ্যে এর খরচ হয় বলে যে কোনও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা কমিউনিটি ক্লিনিকে এটি সহজেই ব্যবহার করা যায়। প্রসব পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের সময় কনডমে স্যালাইন প্রবেশ করিয়ে ব্যবহার করা হলে অল্প সময়ে রক্তক্ষরণ থেমে যাবে, ফলে বেঁচে যাবে মায়ের প্রাণ আর কাটতে হবে না জরায়ু।’
বারডেমের এই ভাসকুলার সার্জন বলেন, “২০০৩ সালে ‘ইউজ অব কনডম টু কন্ট্রোল ম্যাসিভ পোস্টপার্টাম হেমোরেজ’ শিরোনামে মেডস্কেপ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয় ডা. সায়েবার চিকিৎসা পদ্ধতি। পরবর্তীতে মূল রিসার্চ পেপার হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব গাইনি অ্যান্ড অবসে এবং ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে রিভিউ আর্টিকেল হিসেবেও প্রকাশিত হয় এটি। বিশ্বব্যাপী এটি পরিচিতি পায় সায়েবা’স মেথড হিসেবে।”
ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ থেকেও ফিস্টুলা এবং এই পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য তাকে যৌথভাবে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় বলে জানালেন ডা. সাকলায়েন রাসেল। তার ভাষ্য, “আন্তর্জাতিকভাবে ৯৯ সেন্ট আর বাংলাদেশি মাত্র ১০০ টাকার মাধ্যমে ‘সায়েবা’স মেথড’ দিয়ে একজন মায়ের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, কানাডায় ব্যবহৃত হচ্ছে এই ‘সায়েবা’স মেথড।’ কেনিয়ায় এই মেথড নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এক ধাত্রী। অথচ তাকেই এই পদ্ধতির আবিষ্কারক বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বরাতে প্রচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশি চিকিৎসকের সাফল্য এভাবে ঢাকা পড়ে যাওয়া দুঃখজনক।”
আন্তর্জাতিকভাবে নানা জার্নালে সায়েবা’স মেথড প্রকাশিত হলে বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ডা. সায়েবা আখতারের মাধ্যমে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এই মেথড নিয়ে এফসিপিএস ডিজার্টেশন, এমএস থিসিস, পিএইডডি থিসিস আছে। এসব তথ্য জানিয়ে তার সঙ্গে কাজ করা মোশাররেফ সুলতানা সুমি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসকদের নিয়ে আন্তর্জাতিক জার্নাল প্রকাশিত হয়, অথচ সেই কাজের জন্য আমরা স্বীকৃতি দেই আরেক দেশকে, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।’
/জেএ/জেএইচ/