আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পতাকা ওড়াতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছেন অনেকে। সেখানে এ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন আটজন। তাদের মধ্যে আর্জেন্টিনার সমর্থক মিরপুরের বাসিন্দা সুমন ইসলামের দুই পা কেটে ফেলতে হয়েছে। মাহিনের কাটা পড়েছে দুটি আঙুল। খিলগাঁওয়ের কিশোর আজহারের দুই হাত ও হাঁটু পুড়ে গেছে। গলা ও মুখ ঝলসে গেছে রোকনের।
সমর্থক ও ভক্তদের এমন দশা দেখে আক্ষেপ করলেন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। আজ রবিবার (২৪ জুন) তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমিও ফুটবলের ভক্ত। একসময় মাঠে গিয়ে খেলা দেখতাম। কিন্তু এই উন্মাদনার খেসারতে কাউকে হাত-পা হারাতে হবে, এটা কিছুতেই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে সবারই সতর্ক হওয়া উচিত।’
‘আমরা এবার ঢামেক হাসপাতালে সাতজন রোগী পেয়েছি। তাদের আহত হওয়ার কারণগুলো তুচ্ছ। বেশিরভাগই ছাদের ওপর পতাকা ওড়াতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছে। এরকম আগেও হতো। ছাদের ওপর কাপড় শুকাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটে। কারণ সেখানকার বিদ্যুতের তার ভাড়াটিয়া-বাড়িওয়ালা কেউ মনিটরিং করে না। এর খেসারত দিতে হয় সবাইকে। একজন মানুষ ১৫-২০ ভাগ দগ্ধ হলে সেই ঘা শুকিয়ে গেলেও সারাজীবন তাকে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।’
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আজহারের বয়স ১৫ বছর। ১০ ভাগ বার্ন নিয়ে চতুর্থ তলায় ভর্তি আছে সে। সে খিলগাঁওয়ে ভাঙারির দোকানে কাজ করে। ছেলেটি ব্রাজিলের সমর্থক। আজহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছে, ‘এখন খেলা দেখার কোনও সুযোগ নাই আমার। আমি চাই, ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতুক।’
আজহারের মা মুনজিলা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ও নিচের দিকে তাকিয়ে ব্রাজিলের পতাকা ঠিক করছিল, তখন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিচে পড়ে যায়।’
সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রোকনুদ্দিন রোকনও (১২) ব্রাজিলের ভক্ত। কেবিনে ১৩ ভাগ বার্ন নিয়ে ভর্তি আছে সে। নিজেদের বাসার বারান্দায় বাঁকা হয়ে যাওয়া প্রিয় দলের পতাকা ঠিক করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় ছেলেটি। তার মা নার্গিস খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বারান্দার বাইরে ট্রান্সমিটার থাকায় সবসময় আমাকেই সাবধান করতো রোকন। সেই ছেলেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিয়মিত খেলার খবর রাখে সে। ওর খুব ইচ্ছা, ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতুক। ফাইনালের আগের দিন হলেও বাড়ি ফিরে যেতে চায় সে।’
সবচেয়ে করুণ অবস্থা আইসিইউ’র (নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র) নয় নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন সুমন ইসলামের (৪০)। তার দুই পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। সুমনের মা রওশন আরা বেগম শেরেবাংলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঈদের আগের দিন ইফতারির ২০ মিনিট আগে পতাকা বাঁকা ছিল দেখে সোজা করতে গিয়েছিল আমার ছেলে। সে একটা রড দিয়ে সোজা করতে চেষ্টার পরই তার গায়ে আগুন ধরে যায়। আমি দৌড়ে গিয়ে মেইনসুইচ অফ করি, কিন্তু কাজ হলো না। কারণ আমাদের দুটি বাড়ি। সে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছে নির্মাণাধীন বাড়িতে। পরে আশেপাশের মানুষজন এসে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করার পরামর্শ দেয়। সবাই এটা-ওটা বলেছে, কিন্তু কেউ আগুন নেভায়নি। পরে বিদ্যুৎ বন্ধ হলে আমার ছেলে পড়ে যায়। তখন একটা ছেলে দৌড়ে এসে আমার ছেলেকে তোলে।’
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ছেলেটির মানসিক সমস্যা হচ্ছে। তাই শিক্ষিকা রওশন আরা বেগম তাদের বলেছেন, ‘প্রয়োজনে তার জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে কল করুন। ছেলের জন্য সবরকম চিকিৎসা সেবা চাই।’
সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে এই স্কুলশিক্ষিকা বলেন, ‘আর কোনও মা যেন এমন কষ্ট না পায়। পঙ্গু যেন না হয় তার সন্তান। সবাই সচেতন থাকুন। খেলাকে কেন্দ্র করে কারও যেন এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে না হয়। প্রিয় দলের পতাকা টানাতে গিয়ে এমন পাগলামি যেন কেউ না করে, সবার প্রতি আমার এই অনুরোধ রইলো।’
ডা. সামন্ত লাল সেনের ভাষ্য, ‘এটা শুধু এবারের আসরেই নয়, আগের বিশ্বকাপেও একই অবস্থা দেখেছি। তখনও সচেতনতা বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছিলাম। জনসাধারণের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আমরা সবাই যদি সচেতন না হই তাহলে এ ধরনের ইনজুরি বাড়তেই থাকবে। এসব প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কোনও বিকল্প নেই।’
এমন আরও অনেক সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। আর কথা কাটাকাটি ও খেলায় দেখে নেওয়ার হুমকি তো এখন প্রতিদিনের সাধারণ ঘটনা। খুলনা মহানগরীর দৌলতপুরে গত ১৮ জুন সকালে আর্জেন্টিনার দুই সমর্থককে কুপিয়ে আহত করে ব্রাজিল সমর্থকরা। আহতরা হচ্ছেন মো.শুকুর হাওলাদার (৩৫) ও তার স্ত্রী মিনু আক্তার (২৫)। তারা দু’জনই খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এর আগে গত ২৮ মে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় আজেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে পতাকা টানানো নিয়ে সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে আর্জেন্টিনা সমর্থক বাবা-ছেলেকে কুপিয়ে জখম করা হয়।
জানা গেছে, বন্দরের মিনারবাড়ি এলাকায় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে পতাকা ওড়ানোকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বের জেরে রাতে তারাবি নামাজের পর বন্দরের মিনারবাড়ি এলাকার ছেলে সেলিম (৫০) ও তার ছেলে সজীবের ওপর চাপাতি নিয়ে হামলা চালায় ব্রাজিল সমর্থকরা। হামলাকারীরা চাপাতি দিয়ে দু’জনকে কুপিয়ে জখম করে।
বাংলাদেশে বিশ্বকাপ উন্মাদনার এমন পরিণতি পুরনো। এবার এখন পর্যন্ত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের পাগলামি সীমাবদ্ধ আছে সংঘর্ষেই। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে লালমনিরহাটে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে মিলন হোসেন নামে এক তরুণ দুঃখজনকভাবে নিহত হয়েছিলেন। এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিরোধে সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রতি জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
* অশ্রুসজল স্কুলশিক্ষিকা রওশন আরা বেগমের কথা:
আরও পড়ুন-
আর্জেন্টিনার সমর্থক দম্পতিকে কোপানোর ঘটনায় ৮ ব্রাজিল সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলা
খুলনায় আর্জেন্টিনার দুই সমর্থককে কুপিয়েছে ব্রাজিল সমর্থকরা