করোনা ডামাডোলের আড়ালে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ!

ডেঙ্গু মশাকরোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। দেশেও এখন পর্যন্ত প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। সম্ভাব্য খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কায় নেওয়া হচ্ছে নানাবিধ প্রতিরোধী পদক্ষেপ। অথচ গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্বও বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই আগাম পদক্ষেপ না নেওয়া না হলে এবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। করোনার কারণে সব ‘ফোকাস’ সেদিকে চলে গেছে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের দিকটা দুর্বল হওয়ার শঙ্কা তাদের।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৬৯ জন। এর মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৬৫ জন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪ জন। এ হিসাবে  এ বছরের জানুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন এবং ২৩ মার্চ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ জন। গত বছরের জানুয়ারিতে এ সংখ্যা ছিল ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ১৮ এবং মার্চে ১৭।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গতবারের তুলনায় চলতি বছর রোগী ভর্তির সংখ্যা বেশি ঠিকই, তবে গতবার কিছুটা ইনফরমেশন গ্যাপ ছিল, তথ্যগুলো সেভাবে শুরুর দিকে আসেনি। আবার গত মাসে প্রকাশিত পোস্ট মনসুন সার্ভে অনুযায়ী এবারে আবাসিক এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব কম, কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেশি।’

তিনি বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় এডিস মশা কমমানে হচ্ছে মানুষ সচেতন হয়েছে। কিন্তু নির্মাণাধীন স্থাপনা, ড্রাম, পরিত্যক্ত মোটরযানসহ পরিত্যক্ত জায়গাগুলোতে এডিস পাওয়া গেছে।’ এসব কারণে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ হবে না বলে মনে করেন তিনি।

৫ মার্চ শুরু হয়ে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ‘প্রি মনসুন সার্ভে’ হয়েছে। তখন কিছুটা বৃষ্টি ছিল, যা এডিস মশা বাড়ার ‍উপযোগী।

ডা. শাহনীলা জানান, এবারের জরিপে আগের চেয়ে স্থান বেশি নেওয়া হয়েছে। জরিপের কম্পাইলেশনের কাজ চলছে, পুরোটা শেষ হলে বোঝা যাবে প্রকৃত চিত্র কী।

এর সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এবং পরীক্ষা করার কিটের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত বছরে ৪৩ হাজার কিট প্রতিটি উপজেলায় পাঠানো হয়েছে এবং কিছু কিট মজুদ রয়েছে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কাছে। যেন খুবইমার্জেন্সি হলেআমরা দিতে পারি।’

নবীন চিকিৎসকসহ উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং সেটা প্রায় শেষের দিকে বলে জানান তিনি। তৈরি হয়ে গেছে ‘ম্যানেজমেন্ট গাইড’ও। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে অবহিতকরণ সভাও হচ্ছে নিয়মিতভাবে।

এপ্রিল মাসকে ‘প্রতিরোধ মাস’ হিসেবে সরকার ঘোষণা করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এরই অংশ হিসেবে আমরা নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাবো গণমাধ্যমগুলোতে। আর এটা কিন্তু কেবল ঢাকাকে কেন্দ্র করে নয়, দেশের আট বিভাগেই এসব কার্যক্রম চালানো হবে অধিদফতরের পক্ষ থেকে।’

‘করোনা ভাইরাস মোকাবিলার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়েও সমানভাবে কাজ চালাতে হবে এবং পুরো সজাগ থাকতে হবে’, বলেন ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি বছরের প্রথম এই তিনমাসে এডিস মশার যে ঘনত্ব পেয়েছি সেটা অনেক বেশি। এবারে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বেশি। অর্থাৎ ডেঙ্গুর সিজনে রোগীর সংখ্যা বাড়বে যদি আগাম পদক্ষেপ না নেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে সব ‘ফোকাস’ চলে গেছে সেদিকে, তাই শঙ্কা হচ্ছে ডেঙ্গুর দিকটা দুর্বল না হয়।’ তিনি আগাম পদক্ষেপ হিসেবে এডিস মশা নিধনে এবং এডিস মশার প্রজননস্থল কমানোর ওপর জোর দেন।

‘এডিসের ব্রিডিং প্লেস ম্যানেজমেন্টের জন্য মার্চ থেকে মে—এই তিন মাস কাজ করতে হবে এবং মে জুন থেকে স্প্রের কাজ করতে হবে,’ বলেন কবিরুল বাশার।

জানতে চাইলেস্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘কেবল গত বছরের তুলনায় নয়, বলতে গেলে গত ১৮ বছরের তুলনাতেই চলতি বছরের শুরুতে রোগীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু গতবছর যখন রোগী সংখ্যা ১ লাখের বেশি হয়ে গেলো, একদিনেই যখন ২ হাজার ৪০০-এর বেশি রোগী ভর্তি হলো, তাহলে সে হিসাবে একটা মিনিমাম সংখ্যায় নামতেতো সময় লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘সারাদেশে রোগী ছড়ানো, সে হিসাবে এটা কম। কিন্তু যদি রোগী হিসাব করা হয়যেভাবে গত বছর রোগী বেড়েছিল, সেখান থেকে কিন্তু একটা সময়ে রোগী সংখ্যা একেবারে শূন্যে নেমে এসেছিল।আর নতুন বছরের হিসাবের সঙ্গে পুরনো রিপোর্ট মিলবে না এই কারণে যে, গতবছরের কিছুসময় পর থেকে দেশের ৬৪ জেলা থেকে আমরা রোগী সংখ্যা পেতে শুরু করেছিলাম।’

ডা. আয়শা বলেন, ‘তবে গত বছরের ১ লাখ রোগীর তুলনায় রোগী সংখ্যা অনেক কমে এসেছে, এটা স্বস্তির জায়গা। তবে ডেঙ্গু কিন্তু এখন সারাবছরের রোগ। ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য কাজ করা হচ্ছে, তাই আশা করছি, গত বছরের মতো ডেঙ্গু এবারে হবে না।’