করোনাকালে ঝুঁকিতে অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা

নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসঅন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য পরিকল্পনার অভাব, যাতায়াতের বাহন না থাকা, কোন হাসপাতাল অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য সবসময় খোলা রয়েছে, সে সম্পর্কে না জানা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী একজন প্রসূতি নারীকে প্রসবপূর্ব সময়ে চার বার চিকিৎসকের কাছে না নিয়ে যাওয়ার কারণে করোনাকালে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। বর্তমানে বাড়িতে প্রসবের পরিবর্তে যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে এবং চেকআপে আসতে বলা হচ্ছে, সেখানে করোনাকালে যাতায়াত মাধ্যমের সীমাবদ্ধতার কারণে অবহেলার শিকার হচ্ছেন অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা। এই করোনাকালে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
ইউনিসেফ জানিয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাপের মুখে পড়ায়  ও সেবা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে হুমকিতে পড়েছে অন্তঃসত্ত্বা মা ও নবজাতক শিশুরা। গত ৭ মে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইউনিসেফ জানিয়েছে, আগামী ৯ মাসের মধ্যে আনুমানিক ১১ কোটি ৬০ লাখ শিশুর জন্ম হবে। ইউনিসেফ বিভিন্ন দেশের সরকার ও দাতাদের প্রতি অন্তঃসত্ত্বা নারী ও নবজাতকদের জীবন রক্ষাকারী সেবাগুলো অব্যাহত রাখার আহ্বান জানায়। ইউনিসেফ আরও জানায়, বাংলাদেশে কোভিড মহামারি সময়ের মধ্যে আনুমানিক ২৪ লাখ শিশুর জন্ম হবে।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মা মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়ার স্বপ্ন বুনছেন। তাদের এখন এমন একটি বিশ্ব বাস্তবতায় একটি নতুন জীবনকে আনার জন্য প্রস্তুত হতে হবে, যেখানে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে ভয় পাচ্ছেন, বা লকডাউন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাপের মুখে থাকায় তারা জরুরি সেবা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। করোনাভাইরাস মহামারি মাতৃত্বের ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে তা এখন কল্পনা করাও কঠিন।’

ইউনিসেফ সতর্ক করছে যে, কোভিড-১৯ এর জন্য নেওয়া নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের কারণে শিশুর জন্মকালীন সেবার মতো জীবন রক্ষাকারী স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত করতে পারে, যা লাখ লাখ অন্তঃসত্ত্বা মা ও তাদের সন্তানদের বিরাট ঝুঁকিতে ফেলবে।

আর এমনই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার (২৮ মে) পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। করোনার এই মহামারির সময়ে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, অন্তঃসত্ত্বাকালীন শতকরা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারী রক্তশূন্যতায় ভোগেন, অথচ এই সময়ে তাদের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের ছুটতে হচ্ছে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। এতে করে ঝুঁকিতে পড়ছেন মা ও গর্ভের শিশু, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস বিঘ্নিত হচ্ছে। তারা বলছেন, করোনার এই সময়ে সরকারকে প্রসূতি মায়েদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিদ্যা বিশেষজ্ঞ এবং কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়েই অন্তঃসত্ত্বা নারী একটু বেশি সংবেদনশীল থাকে অর্থাৎ তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। আর কোভিড যেহেতু সংক্রামক রোগ, তাই অন্তঃসত্ত্বা নারীরও সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। আর যদি তার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, হাঁপানি থাকে তাহলে তার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। আবার এই মায়েরা গর্ভকালীন বা প্রসবকালীন সময়ে আরও ঝুঁকিতে পড়ে যায় কোভিড-নন কোভিড হাসপাতালের চক্করে পড়ে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, ‘গর্ভকালীন প্রথম ১২ সপ্তাহে একবার, ২০ থেকে ২৮ সপ্তাহের একবার, ২৮ থেকে ৩৪ এবং  প্রসবের দুই সপ্তাহ আগে একবার একজন গর্ভবতী নারীকে চিকিৎসকের কাছে ফলোআপে যাওয়ার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনে বলা আছে। আবার প্রসব পরবর্তী চেকআপও রয়েছে।’ কিন্তু বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত আইডিয়াল বা আদর্শ যে চেকআপ সেটা এখনও শতকরা ৫০ শতাংশই ক্রস করেনি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এখনও বেশিরভাগ প্রসবই বাড়িতে হচ্ছে। গর্ভকালীন চেকআপ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যার কারণে তাদেরকে আলাদা করে নজর দেওয়া হয়, যাতে করে মাতৃ মৃত্যুর হার এবং দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা কমিয়ে আনা যায়।’

চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভকালীন জটিলতায় একজন মায়ের মারা যাওয়ার আগে কমপক্ষে ছয় থেকে ১২ ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক—এতগুলো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থাকার পরও এত সময় পাওয়ার পরও একজন মাকে হাসপাতালে নেওয়া হয় না। এর একমাত্র কারণ, তাকে হাসপাতালে নেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করা, এরপর হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি এবং হাসপাতালে যাওয়ার পর ম্যানেজমেন্ট পেতে দেরি। স্বাভাবিক সময়ে  প্রসূতি মায়েদের এই অবস্থা হলে এই করোনাকালে, যখন সাধারণ ছুটিতে সব বন্ধ রয়েছে— এমন পরিস্থিতিতে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা কী পরিমাণ হওয়ার কথা, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।

আবার মারা যাওয়া অন্তঃসত্ত্বা নারীর মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগই টিনএজার মা উল্লেখ করে ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, ‘‘অথচ এই মৃত্যুগুলো সম্পূর্ণভাবে প্রিভেন্টেবল ছিল। যদি নিয়মিত চেকআপ এবং হাসপাতালে প্রসব করানো হতো, তাহলে এসব মাতৃ মৃত্যু প্রতিরোধ করা যেতো। দেশে মাতৃ মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ, শতকরা ৩১ শতাংশ মা এই কারণে মারা যান। কিন্তু প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণের অন্যতম চিকিৎসা হচ্ছে তাকে রক্ত দেওয়া। কিন্তু করোনাকালে রক্তদাতা পাওয়া যাচ্ছে না।  আবার এই পরিস্থিতিতে রক্ত দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্লাড ব্যাংকও খালি, তাই এটাও এখন একটা ‘ফ্যাক্টর’।’’

ডা. রেজাউল করিম কাজল, এই লকডাউন পরিস্থিতে চিকিৎসা পাওয়া, চিকিৎসার গুণগত মান না থাকা এবং ওষুধের দোকান খোলা না থাকা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ এই সময়ে পাওয়া না যাওয়া, ব্যাংক থেকে টাকা না তুলতে পারা—  সবকিছু মিলিয়ে সবচাইতে ঝুঁকিতে রয়েছে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। এই কারণে ভোগান্তি, দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা কিংবা মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে।’