জোনভিত্তিক কঠোর পদক্ষেপ নিলে এখনও সংক্রমণ কমানো যাবে

করোনাভাইরাসরোগীর সংখ্যা অনুযায়ী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যেসব এলাকায় রোগী সংখ্যা বেশি সেসব এলাকা রেড, তারচেয়ে কম রোগীর এলাকাকে ইয়োলো এবং যেসব এলাকায় এখনও রোগী পাওয়া যায়নি সেসব এলাকাকে গ্রিন জোন হিসেবে ভাগ করে করোনা প্রতিরোধে কাজ করবে সরকার। সোমবার (১ জুন) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পুরো দেশকে জোনভিত্তিক ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেরিতে হলেও সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল এপ্রিল বা মে মাসের শুরুতে, যখন কিনা সব জায়গায় করোনা ছড়ায়নি। তবে এখনও যদি জোন ভাগ করে সে অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায় তাহলেও সংক্রমণ কমানো যাবে।

রেড জোনকে ফোকাস করতে হবে ম্যানপাওয়ার, লজিস্টিক, অর্থনৈতিক বরাদ্দ বেশি দিয়ে এবং আনুপাতিক হারে। প্রয়োজন অনুযায়ী সেটা ইয়োলো ও গ্রিন জোনেও ভাগ হবে। একইসঙ্গে রেড জোনকে বাদ দিয়ে ইয়োলো এবং গ্রিন জোনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে হবে। জোনিংয়ের ওপর নির্ভর করে এখন পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। রেড জোন থেকে ইয়োলো এবং গ্রিন জোনে যেন মানুষ চলাচল না করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে, তাহলেই সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।

তারা বলছেন, রোগীর সংখ্যার দিক থেকে যেসব জেলা ওপরের দিকে রয়েছে সেগুলোকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোর লকডাউনে নিতে হবে। তারচেয়ে কম রোগীর জেলাগুলোকে ইয়োলো জোন এবং ১০০ বা এর নিচে অথবা একেবারেই রোগী নেই যেসব এলাকায় সেগুলোকে গ্রিনজোন হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। আর গ্রিনজোনে সব ধরনের কর্মকাণ্ড চলবে। তবে শনাক্ত হওয়া রোগীদের আইসোলেশনে এবং তাদের সংস্পর্শে আসাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। কোনোভাবেই হোম কোয়ারেন্টিনে উৎসাহিত করা যাবে না। আর গ্রিনজোনের কোয়ারেন্টিন ১৫ দিনের বেশি হতে হবে না।

সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, যেসব এলাকায় করোনার সংক্রমণ বেশি সেসব এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। ওই এলাকার লোকদের বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে। বাইরে থেকেও রেড জোনে লোকদের প্রবেশ সীমিত করার উদ্যোগ নেবে সরকার। আর যেসব এলাকায় করোনার সংক্রমণ কম, সেসব এলাকাকে ইয়েলো জোন হিসেবে চিহ্নিত করে আক্রান্তদের ঘরবাড়ি লকডাউন করে সংক্রমণের বিস্তার ঠেকানো হবে। যেসব এলাকায় এখনও করোনা রোগী পাওয়া যায়নি, সেসব এলাকায় যাতে বাইরের কেউ ঢুকতে না পারে সে ব্যবস্থা করা হবে।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিন জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আজ ৮৭তম দিনে এসে করোনা শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। মারা গেছে ৭০৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ দুই হাজার ৯১১ জন রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিশ্বে করোনা সংক্রমিত শীর্ষ ৩০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২১তম।

জানতে চাইলে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জোনিংয়ের ওপর নির্ভর করে এখন পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। সংক্রমণের হার রেড জোনে বেশি ধরে নিলে ফোকাসটা হবে রেড জোনে বেশি। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এসব এলাকায় পরীক্ষা সংখ্যা, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার অর্থাৎ হাসপাতাল বেশি প্রস্তুত রয়েছে কিনা, চিকিৎসক-নার্সসহ অন্য জনশক্তিকে রেড জোনে বেশি নিয়ে আসতে হবে। এমনকি গ্রিন জোন থেকে জনশক্তিকে স্থানান্তর করতে হবে—এভাবেই রেড জোনকে ফোকাস করতে হবে।

আর যদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে হয় তাহলে ইয়োলো জোনে মাঝারি এবং গ্রিন জোনে সেটা খুবই সহজ হবে। রেড জোনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ভালো হয় রেড জোনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা। যদি চালু রাখতেই হয় তাহলে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

একটু দেরিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো কিনা জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ বলেন, কোনও সন্দেহ নেই যে এই সিদ্ধান্ত আরেকটু আগে নিয়ে ভালো হতো। দেশে কোনও লকডাউনই হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, পোশাক শ্রমিকরা ঢাকায় যাতায়াত করলেন, ঈদের আগে, রোজার সময়ে মানুষ ঘর থেকে বের হলেন… এমন অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে ক্যালকুলেশন ঠিক করা যায় না।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, সাধারণ ছুটি বাতিল না করে যেখানে রোগীর সংখ্যা বেশি, যেখানে গণহারে সংক্রমণ হচ্ছে, সেখানে ছুটি থাকতে হবে। মাঝারি এলাকাতে জরুরি কাজ করা যাবে, আর যেখানে রোগী কম সেখানে সাবধানতার সঙ্গে খুলতে হবে। তবে দেরিতে হলেও এটা হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকার দেরিতে হলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। তবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল এপ্রিলের বা মে মাসের শুরুতে, যখন কিনা সব জায়গায় করোনা ছড়ায়নি। এখন রেড জোন হিসেবে বিবেচিত হওয়া জেলাগুলোতে কঠিনভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, জনগণ নিয়ম মানতে চায় না, তবে জনগণকে মানাতে হবে এবং এ দায়িত্ব রাষ্ট্রের। একইসঙ্গে, রেড জোনে পরীক্ষার আওতা অনেক বেশি বাড়াতে হবে, যাতে একজন মানুষও পরীক্ষার বাইরে না থাকে। কারণ, একজনও যদি পরীক্ষার বাইরে থাকে এবং তিনি যদি পজিটিভ হন তাহলে তিনিসহ তার সংস্পর্শে আসা সবাই ছড়াতে থাকবে।

অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হকের পরামর্শ, রেড জোনে প্রত্যেককে শনাক্ত করে আইসোলেশনে নিয়ে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। আর তার সংস্পর্শে যারা আসবে তাদের কঠিনভাবে হোম নয়, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। তাই রেড জোনে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে। স্কুল-কলেজ-খেলার মাঠ এসব জায়গা কাজে লাগাতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের জন্য। এটা যদি কড়াকড়িভাবে করা যায় তাহলে সংক্রমণ কমানো যাবে।

অফিসিয়ালি জোনিং বলা হোক বা না হোক আমাদের মধ্যে ‘প্রায়োরিটি’ সব সময় ছিল এবং নিয়মিত ভিত্তিতে কেসের সংখ্যা নিয়মিত ওয়েবসাইটে দেওয়া হচ্ছিল মন্তব্য করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একইসঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আইইডিসিআর অ্যানালাইসিস করছে। কোথায় রোগী বাড়ছে, কোথায় কমছে, কোথায় ক্লাস্টার আকারে আছে—কোথায় কী ম্যাজার নিতে হবে, সেসবই আইইডিসিআর করছে। তিনি বলেন, এখন যখন লকডাউন উঠে গেছে এখন সেই চ্যালেঞ্জটা বেশি হয়েছে। কারণ, রোগী যতক্ষণ না জানছে সে পজিটিভ তখন তাকে ট্রেস করা যাচ্ছে না, কারণ সবাই এখন বের হচ্ছে। তাই এখন আমরা অন্যভাবে চিন্তা করছি, লকডাউনের আগে যেভাবে ছিল। যেমন, কন্টাক্ট ট্রেসিংকে জোরদার করা এবং জোনগুলোকে আরও বেশি নজরদারিতে আনা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জোনওয়াইজ লোক চলাচল বন্ধ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দেশের ৮০ শতাংশ এলাকা এখনও গ্রিন। এই গ্রিন এলাকাগুলো আমরা গ্রিনই রাখতে চাই। সেসব এলাকায় বহিরাগতদের মাধ্যমে যেন করোনা না ছড়ায় সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রেড ও ইয়োলো এলাকা চিহ্নিত করে সেসব এলাকার পকেটগুলোও চিহ্নিত করে রেসট্রিক্টেড করা হবে। সেক্ষেত্রে পুরো ঢাকাকে হয়তো করা হবে না, কিছু পাড়া, মহল্লা ও ভবন চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এসব বিষয় যখনই ট্রেস করা শেষ হবে তখনই আমরা ইমপ্লিমেন্টেশনে যাবো।

জোনে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি হয়ে গেল কিনা—প্রশ্নে হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিটি কাজই করা হয় প্রয়োজনভিত্তিক, এতদিন যেগুলো প্রয়োজন ছিল সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এখন কন্টামিনেশনের যে মাত্রা তাতে এই মুহূর্তে এটাই প্রয়োজন। কোনও কিছু দেরি বলা যাবে না। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা কাজ করছি, বাইরে থেকে তো সমালোচনা করাই যায়।