ছোট শহরে করোনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার বেশি

2 (1)

চার মহানগরসহ দেশের আট বিভাগীয় শহরের তুলনায় জেলা শহরগুলোতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ বেশি। আট নগরীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বেড, চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকার পরও এখানে রোগীর ভর্তি হার জেলাগুলোর চেয়ে কম। রাজশাহী নগরীতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ১৩ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিয়ে মানুষের সন্তোষ প্রকাশের কথাও জানা গেছে। বিপরীতে আট নগরীর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে রোগীদের অভিযোগ রয়েছে।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত বিভিন্ন জেলার রোগী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার সিভিল সার্জন, জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা রোগীদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে বেশ আন্তরিক ছিলেন। এমনকি জেলা ও উপজেলায় চিকিৎসকরা করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও চিকিৎসা দিয়েছেন।

গত ১৩ জুলাই পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুর এই আট মহানগরীর চেয়ে বাকি ৫৬ জেলা শহরে হাসপাতালে রোগীর ভর্তির হার বেশি ছিল। অথচ এই এই আটটি নগরীতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থার আয়োজন সবচেয়ে বেশি রয়েছে।

Chart-2 (1)আট নগরীতে আক্রান্ত মোট রোগীর ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। একই সময় ৫৬ জেলায় আক্রান্ত করোনা রোগীর ১৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। যা আট নগরীর চেয়ে প্রায় দুই শতাংশের বেশি। আট নগরীর চেয়ে জেলায় সুস্থতার হারও বেশি। জেলায় সুস্থতার হার ৫৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর আট নগরীতে করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থতার হার ৫২ দশমিক ৬১ শতাংশ।

জেলাগুলোতে হাসপাতালে করোনা রোগীর ভর্তির হার বেশি হলেও আট নগরীর চেয়ে মৃত্যুর হার সামান্য বেশি রয়েছে। আট নগরীতে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ২৮ শতাংশ। অপরদিকে বাকি জেলাগুলোতে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় মৃত্যুর হার বেড়েছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশের জেলাগুলোর ভেতরে কুড়িগ্রামে হাসপাতালে ভর্তির হার সবচেয়ে বেশি। গত ১৩ জুলাই পর্যন্ত এই জেলায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী ছিল ২৭৭ জন। এর মধ্যে ১৫১ জন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালে ভর্তির হার ৫৪ দশমিক ৫১ শতাংশ। এই জেলায় আক্রান্তদের মধ্যে ১৩৫ জন সুস্থ হয়েছেন। মারা গেছেন সাত জন করোনা পজিটিভ ব্যক্তি। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি সাধারণত বাড়িতে রোগীদের আইসোলেশনে রাখার। কিন্তু রোগীর আস্থার জন্য চিকিৎসকদের সান্নিধ্যে রাখতে হাসপাতালে ভর্তি করে থাকি। রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসকদের কাছাকাছি থাকলে তাদের মনোবল শক্ত হয়। এটা একটা মানসিক দৃঢ়তার দিক। আমরা সে বিষয়টা মাথায় রেখে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করে থাকি।’ তবে এই সিভিল সার্জনের জানা ছিল না, রোগীর হাসপাতালে ভর্তির হার তার জেলায় বেশি।

জয়পুরহাটে করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর  সুস্থ হয়ে গত সপ্তাহে বাড়ি ফিরেছেন এক রোগী। তিনি জেলা হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে বলেন, ‘হাসপাতাল আর বাড়ি একই রকম হবে না। তবে চিকিৎসকরা আন্তরিক ছিলেন। আমার একটু শ্বাসকষ্ট ছিল। তাই চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। প্রায় দুই সপ্তাহের মতো হাসপাতালে ছিলাম। এখন সুস্থ। হাসপাতালের খাবার-দাবারও মোটামুটি ভালো ছিল।’

জয়পুরহাটেও হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার বেশি। ১৩ জুলাই পর্যন্ত এই জেলায় আক্রান্ত মোট রোগীর ৪৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এবিষয়ে জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. সেলিম মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি আক্রান্ত রোগীদের সন্তুষ্ট করার। যাতে তারা আতঙ্কিত না হন। করোনা আক্রান্ত হলেই মৃত্যু, এরকম আতঙ্কে রোগীরা কাবু হয়ে যান। তাই আমাদের চিকিৎসকরা আন্তরিক হয়ে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিতেন। হাসপাতালে ভর্তির পাশাপাশি যাদের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে তাদের টেলিমেডিসিন সেবা স্ট্রংলি চালিয়েছি। মেডিক্যাল টিম করেছি। রোগীদের বাড়িতে গিয়েও চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের রোগীর সংখ্যা এখন কমে আসছে। আক্রান্ত হলেও রোগীদের অবস্থার অবনতি কম হয়। এরপরও বর্তমানে ৭০ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলশনে রেখেছি।’

জেলার সিভিল সার্জনসহ বিভিন্ন জেলার চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা রোগীদের বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন বলে জেলার হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর ভর্তির হার বেশি ছিল।

1 (2)মহানগরীর ভিন্ন চিত্র

এদিকে আট মহানগরীতে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। এসব মহানগরীতে রোগী ভর্তির হার হলো- ঢাকায় ১৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, চট্টগ্রাম ১০ দশমিক ৫১ শতাংশ, সিলেটে ১৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১১ দশমিক ২৩ শতাংশ, খুলনায় ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ, বরিশালে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ, রংপুরে ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং রাজশাহীতে সবচেয়ে কম মাত্র ১ দশমিক ১৩ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাকিদের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

১৩ জুলাই পর্যন্ত রাজশাহীতে ১৬৭৯ রোগীর মধ্যে মাত্র ১৯ জন হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। বাকিদের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এই নগরীতে ১৩ জুলাই পর্যন্ত ১৭ জন রোগী মৃত্যুবরণ করেছেন। সুস্থতার হার ছিল ২০ দশমিক ১৩ শতাংশ। রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে সিটি করপোরেশন মনিটরিং করে থাকে। তবে সিটি করপোরেশনের বাইরে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সিভিল সার্জনের দেখভালে চিকিৎসা হয়।

রাজশাহীতে হাসপাতালে ভর্তির হার এত কম থাকার বিষয়ে রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন মহা. এনামুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে করোনা আক্রান্ত রোগীর সবার তো হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই। ৮০ শতাংশ রোগী এমনিতেই সুস্থ হয়ে যায়। মাত্র ২০ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। যাদের আমরা মনে করেছি হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন রয়েছে, তাদেরই হাসপাতালে ভর্তি করেছি। বাকিদের বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা দিয়েছি।’

Chart-1
আট নগরীতে হাসপাতালে চিকিৎসক ও বিভিন্ন ধরনের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও রোগীর ভর্তির হার কম হওয়ার বিষয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর অন্যতম উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়, তখন বড় শহরগুলোতে ভর্তির হার বেশি ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বড় শহরের সংক্রমণ হার কমে গেছে। জেলা শহরে বেড়েছে। তাই জেলা শহরে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার হারও বেড়েছে। এছাড়া জেলা শহরে মানুষ করোনার আতঙ্ক থেকেও হাসপাতালমুখী হয়েছে। আট নগরীতে আক্রান্তদের বেশিরভাগই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে চাচ্ছে, তাই হাসপাতালে ভর্তির হার কম। এছাড়া হয়তো জেলার সিভিল সার্জন ও চিকিৎসকরাও রোগীদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে আন্তরিক, তাই জেলায় ভর্তির হার বেশি।’

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি জেলাগুলোতে আট মহনগরীর তুলনায় সংক্রমণ বেড়েছে। আমরা আশঙ্কা করছি এই সংক্রমণ জেলা থেকে ফের আট নগরীতে ঢুকবে কোরবানির ঈদে। এজন্য আমাদের সতর্ক হতে হবে।’