বাড়ছে করোনা: গেম চেঞ্জার কী?

দেশে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েই চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন সংক্রমিত হয়েছেন ৪ হাজার ৮৪৬ জন; যা গত দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। ফলে প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলা এবং পরে সেসব জেলা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে পাশের জেলাগুলাতেও। যার কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাড়ছে।

একইসঙ্গে গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৬০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে; সেখানে ৬৮ শতাংশ ভারতীয় তথা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ২২ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট এবং বাকি নমুনাগুলো ১২ শতাংশ নাইজেরিয়ার ইটা ভ্যারিয়েন্ট। দেশে এ তিন ভ্যারিয়েন্ট এবং মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতায় করোনা সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতেও রোগী বাড়ছে। অনেক হাসপাতালের আইসিইউ রোগীতে পূর্ণ থাকছে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, জুন মাস স্বস্তির হবে না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ যদি প্রতিরোধ না করা যায় তাহলে করোনার পরিস্থিতি আগের চেয়েও বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। আর এ বিপর্যয় ঠেকাতে গেইম চ্যাঞ্জার হিসেবে তিন পদ্ধতির কথা বলছেন তারা। ভ্যাকসিন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং রোগী বা সম্ভাব্য রোগীকে কোয়ারেন্টিনে রাখা। এর মধ্যে প্রথমটি, অর্থাৎ ভ্যাকসিনের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। কিন্তু অপর দুটি হাতেই রয়েছে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রতিটি শনাক্ত রোগী যারা হাসপাতালে যাচ্ছেন না, তাদের সবাইকে চিকিৎসা-আইসোলেশনে নিতে হবে। রোগীর পরিবার তথা তার সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিনের আওতায় আনতে হবে। তবে সেটা করোনার শুরুর মতো বাড়িতে বাড়িতে লাল পতাকা না টাঙিয়ে সহযোগিতামূলক হতে হবে।

একইসঙ্গে মানুষকে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে এবং সেখানে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর তৃতীয় পদক্ষেপ হিসেবে তিনি টিকা দেওয়ার কথা বললেও যেহেতু টিকা আমাদের হাতে নেই, তাই প্রথম এবং দ্বিতীয় পদক্ষেপের ওপর জোর দিতে হবে। এ কাজে শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই- বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।

অতি সম্প্রতি দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতির পর সরকারের পক্ষ থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, এলাকাভিত্তিক লকডাউন দিয়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে কিছুটা কাজ হচ্ছে।

কিছু কিছু জেলাতে যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছিল কিন্তু পদক্ষেপ নেওয়ার পর সংক্রমণ কমেছে বলে দেখা গেছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধি সমন্বিতভাবে কাজ করলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ১৪ থেকে ১৬ দিনের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এটা কোনও ম্যাজিক ছিল না, কেবল সংক্রমিত রোগীদের শনাক্ত করার জন্য বেশি করে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জনসহ অন্যরা একসঙ্গে কাজ করেছেন। যার ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেখানকার আম বাগানগুলোতে অ্যান্টিজেন টেস্টিং কিট পাঠিয়ে টেস্ট করা হয়েছে, রোগী শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশন করা হয়েছে। ১৪ দিন রাখা হয়েছে। মোর টেস্টিং-মোর আইসোলেশন। আর এসব রোগীর সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরাতে উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। কেবল পুলিশ নয়, বিজিবি, গ্রাম পুলিশ, রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগিয়েছে প্রশাসন।

কেবলমাত্র এই দুটো কাজ করে ২০ থেকে ২২ দিনের মধ্যে সংক্রমণের হার ৫৯ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা গেছে। একইসঙ্গে নাটোরেও এই কাজ করা হয়েছে। সেখানেও সংক্রমণের হার ৪০ শতাংশ থেকে কমে এসেছে।

তাই অধ্যাপক জামিল গুরুত্ব দেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর। বলেন, কেবল মাস্ক পরাতে পারলেও ট্রান্সমিশনের চেইন ব্রেক করা যাবে। শনাক্ত রোগীদের ১৪ দিনের আইসোলেশনে রাখলেও ট্রান্সমিশনের চেইন ব্রেক হবে-তাই এই কাজগুলো জরুরি ভিত্তিতেই করতে হবে।