সক্ষমতা নেই তবু ডেঙ্গু ডেডিকেটেড

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কেবল চলতি মাসের ৪ দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ১৪৫ জন আর মারা গেছেন পাঁচ জন। দেশে চলতি বছরের শুরু থেকে ৪ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৫০১ জন আর মারা গেছেন ৫১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৬৫ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন এক হাজার ২৭৩ জন।

যত দিন যাচ্ছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে। আগের তুলনায়  গুরুতর অসুস্থতার হারও বাড়ছে। গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাশেদুল হাসান কনক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আগের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর শুরুতেই তীব্র জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা ও বমির উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। আর শিশুদের ক্ষেত্রে পেট ব্যথাও লক্ষ করা যাচ্ছে।

করোনা মহামারির মধ্যে ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ ধারণ করায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ২৩ আগস্ট ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ছয়টি হাসপাতালকে ডেডিকেটেড ঘোষণা করে। হাসপাতালগুলো হলো—স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল, কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা হাসপাতাল ও গাজীপুরের শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল।

তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের সক্ষমতা যাচাই না করেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ঘোষণা দিয়েছে। পর্যাপ্ত জনবল, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য অবকাঠামো না থাকায় চিকিৎসা শুরু করতে পারছে না কোনও কোনও হাসপাতাল। কোনও হাসপাতাল সীমিত সম্পদের ব্যবহার করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. সাইদুন নাহার হাসপাতালের সীমিত সম্পদের কথা স্বীকার করে বলেন, সীমিত সম্পদ রিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি চিকিৎসা দেওয়ার। তবে সংকট কিছুটা রয়েছে—এটা মানতেই হবে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য এ হাসপাতাল এখনও প্রস্তুত নয় জানিয়ে লালকুঠি জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. শামছুল করিম বলেন, জনবল এখনও আসেনি। আউটডোর চালাচ্ছি কেবল ফিভার ক্লিনিক দিয়ে কিন্তু ইনডোর না।

রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না, মেডিসিন নেই, নার্স নেই, রেডিওলজিস্ট নেই-টেকনোলজিস্ট নাই জানিয়ে তিনি বলেন, আমার ডাক্তার-নার্স-টেকনোলজিস্ট দরকার, এটা জানিয়েছি কিন্তু এখনও আসেনি।

মেডিসিন কনসালটেন্ট পাঁচ জন, মেডিক্যাল অফিসার ২০ জন, নার্স ২০ জন, টেকনোলজিস্ট চারজনসহ ডেঙ্গু টেস্ট করার জন্য রি-এজেন্টের চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে বলেও জানান ডা. শামছুল করিম।

এদিকে, রেলওয়ে বিভাগের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালকেও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল এখনও অফিসিয়াল অর্ডারই পায়নি। সেইসঙ্গে নেই হাসপাতালের জনবল। নেই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। প্যাথলজিস্ট আছেন একজন। তার একার পক্ষে ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালের কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়। ইনডোরে মেডিক্যাল অফিসার রয়েছেন মাত্র একজন, নার্স রয়েছেন মাত্র নয়জন। অথচ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ইমার্জেন্সি কিছু টেস্ট করা দরকার হয় যখন তখন, বলছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই হাসপাতালে কোনও পোস্টই নেই জানিয়ে হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. রিপন দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অন্তত দুজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, আরও একজন প্যাথলজিস্ট, আরও একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান, চার জন মেডিক্যাল অফিসার এবং আরও অন্তত ১০ জন নার্স দরকার।

সক্ষমতা যাচাই না করে, প্রস্তুতি না নিয়ে হঠাৎ করেই হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা করা হলো কেন—এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ- ই- মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরে যারা রয়েছেন তাদের কথার সঙ্গে বাস্তবতার কোনও মিল নেই।

সরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে, ভোগান্তির কারণে সাধারণ মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছে। অন্য হাসপাতালে চাপ পড়ছে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. রশীদ- ই- মাহবুব বলেন, যে হাসপাতালগুলোকে সরকার নির্ধারণ করে দেবে তাদের ম্যানেজ করার সক্ষমতা রয়েছে কিনা সেটা আগে দেখবে সরকার। সেই সঙ্গে হাসপাতালগুলোর কী প্রয়োজন রয়েছে সেটাও দেখবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর এই দুটো কাজ করার পর তারা সশরীরে হাসপাতাল পরির্দশন করে দেখবে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত হয়েছে কিনা-কার্যক্রম চালানোর জন্য তারা প্রস্তুত কিনা। এরপর তারা মানুষকে নির্ধারিত হাসপাতাল সম্পর্কে জানাবে। মানুষ তখন যাবে, চিকিৎসা নেবে। অথচ হচ্ছে উল্টো। প্রস্তুত না করে, সক্ষমতা যাচাই না করে গণমাধ্যমে তারা বলে দিচ্ছে, মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে। যেটা হওয়া উচিত যেটা হতে পারে না বা হওয়া উচিত নয়।

প্রস্তুত না করেই হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড কেন করা হলো জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক  (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের একটা জুম মিটিংয়ে এরকম একটা সিদ্ধান্ত ছিল। সে অনুযায়ী ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল। তবে এখন চেষ্টা করা হচ্ছে, হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করার জন্য।

তবে ডেডিকেটেড ঘোষণা করা রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আর লালকুঠি জেনারেল হাসপাতাল পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের অধীনে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব হাসপাতালে জনবলসহ অন্যান্য সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি।