বেশি কাজ করলে বা হাঁটলে প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগে জানিয়ে আব্দুল হালিম বলেন, ‘শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি ভর করে আছে। কিছু মনেও রাখতে পারি না।’
করোনা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেয়েছেন এমন মানুষ নেই বললেই চলে। করোনার যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে মাসের পর মাস। এমনকি বছরও। ভুক্তভোগীরা বলছেন, করোনা চলে যায়, কিন্তু রেখে যায় ক্ষতচিহ্ন।
করোনা সেরে ওঠার পর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন শাহরিয়ার শাকিল। চুল পড়ে গেছে তার। কাটেনি দুর্বলতা। ঘুম না হওয়া ও ভুলে যাওয়ার সমস্যা আছে তারও। শাহরিয়ার বলেন, ‘প্রতি মুহূর্তে করোনা বুঝিয়ে দিচ্ছে, জীবনে সে এসেছিল। তাকে ভোলার সুযোগ নেই।’
দেশে করোনা সংক্রমণের হার কমছে, মৃত্যু কমে এক অঙ্কে নেমেছে। কিন্তু লং কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে দেশে।
বিশ্বখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট-এর গবেষণা জানাচ্ছে, করোনা থেকে সেরে ওঠা এক তৃতীয়াংশ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি স্নায়বিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। ১৭ শতাংশ ভুগছেন উদ্বেগজনিত সমস্যায়। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না ১৪ শতাংশ। আবার নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন জানাচ্ছে, করোনার পর অনেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন।
দেশের চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা নেগেটিভ হওয়ার ১২ সপ্তাহ বা তিনমাস পরও যদি এমন কোনও অসুস্থতা থাকে, যার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, সেটাই লং কোভিড। যে কয়দিন রোগী করোনা আক্রান্ত থাকেন সেসময় শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। কেউ সামলে ওঠেন। কেউ পারেন না। যে কারণে করোনা-পরবর্তী জটিলতায় মারাও যাচ্ছেন অনেকে।
লং কোভিডের সমস্যার তালিকায় আরও আছে ক্রনিক ফ্যাটিগ তথা মারাত্মক অবসাদগ্রস্ততা, দুর্বলতা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, ক্রনিক হাইপোক্সিয়া (করোনা থেকে সেরে ওঠার পর অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম), মাংসপেশীতে ব্যথা, চুল পড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি বিভাগের উদ্যোগে করা হয় পোস্ট কোভিড-১৯ পালমোনারি ফাইব্রোসিস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট শীর্ষক এক গবেষণা। ৫০০ রোগীর ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা আক্রান্ত হওয়ার তিনমাস পরও ৪০ শতাংশ রোগী নানা জটিলতায় ভুগছেন। কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, গন্ধ কম পাওয়া, নাক দিয়ে পানি পড়া, মানসিক অবসাদ, ভুলে যাওয়া, মাথাব্যথা রয়েছে এ তালিকায়। বয়স্কদের মধ্যেই সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছে বেশি।
দেশে লং কোভিড আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢামেক হাসপাতালের পোস্ট কোভিড ইউনিট চালুর পর থেকে প্রায় ৮০০ জনের মতো রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে এই হাসপাতালে ভর্তি থেকে করোনার চিকিৎসা নিয়েছিলেন এমন রোগীই বেশি। বাইরে থেকে আসছে কম। এমনটা জানালেন, ইউনিটের মুখপাত্র ও মেডিসিন বিভাগের ডা. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক। এ রোগীদের ফলো-আপে রাখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
পোস্ট কোভিডে কোন ধরনের জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “একটু হাঁটলে বা ‘রেস্টলেস’ অবস্থায় শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সেইসঙ্গে ভুলে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, চুল পড়া, দুর্বলতা, বুকে ও শরীরে ব্যথা, কাশি, অবসাদ, বিষন্নতা, ঘুমের সমস্যা—এমন রোগীর সংখ্যাও অনেক।”
মাহফুজুল হক আরও বলেন, ‘করোনার কারণে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। অ্যাজমার সমস্যাও হচ্ছে অনেকের। কোমরবিডিটি (আগে থেকেই অন্যান্য রোগে আক্রান্ত) মিলে অবস্থা জটিল হয়েছে অনেকের। আবার ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ আগে ছিল না, করোনার পর হয়েছে—এমন রোগীও নেহায়েত কম নয়।’
গ্রিনলাইফ মেডিক্যাল কলেজের অ্যান্ডোক্রাইনলোজি অ্যান্ড মেটাবোলিজম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানজিনা হোসেন নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনের বরাত দিয়ে বলেন, ‘করোনা সেরে ওঠা রোগীদের ব্লাডসুগারও ওঠানামা করছে বেশি। যারা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তাদের অনেককে স্টেরয়েড দেওয়া হয়েছিল। এতেও সুগার বাড়ে। অনেকের ডায়াবেটিস স্থিতিশীল হতে কয়েকমাসও লেগে যাচ্ছে।’