দেশে প্রথমবারের মতো ভ্রূণের জিনগত ত্রুটি নির্ণয় পরীক্ষা শুরু

অটিজম ও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম প্রতিরোধের লক্ষ্যে দেশে প্রথমবারের মতো গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাসের ভ্রূণের ক্রোমোজোমাল বা জিনগত ত্রুটি নির্ণয় পরীক্ষা চালু করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। মঙ্গলবার (১৪ জুন) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিলন হলে এই পরীক্ষার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ, ফিটোম্যাটারনাল মেডিসিন বিভাগ, রেডিওলজি ইমেজিং বিভাগ এবং ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের সমন্বয়ে এই পরীক্ষা চালু করা হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।

বিএসএমএমইউ জানায়, এখন থেকে বিএসএমএমইউতে দেশেই মায়ের গর্ভে ১১ হতে ১৪ সপ্তাহে অর্থাৎ বাচ্চার আকার যখন দেড় থেকে দুই ইঞ্চি, তখনই মায়ের গর্ভে ভ্রুণের ডাউন সিনড্রোম ও অন্যান্য ক্রোমোজোমাল ত্রুটিতে আক্রান্ত কিনা, তার ঝুঁকি নির্ণয় পরীক্ষা করা যাবে। পরীক্ষায় উচ্চ ঝুঁকি পাওয়া গেলে তা আরেকটি পরীক্ষার মাধ্যমে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটোরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবতোষ পাল। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন ব্যাসিক সায়েন্স ও প্যারা ক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. শিরিন তরপদার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ল্যাবরেটোরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাইফুল ইসলাম। প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল দেশে ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের সংখ্যা ও সমাজে তার প্রভাব নিয়ে আলোকপাত করেন। রোস ডায়াগনস্টিকের  ব্যবস্থাপনা পরিচালক  নরেন্দ্র ভাদ্রে ও জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ডা. দিপিকা জিনদাল গর্ভাবস্থায় ভ্রুণে জেনেটিক ত্রুটি নির্ণয়ের প্রযুক্তিগত ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত বলেন।

অনুষ্ঠান থেকে জানানো হয়, দেশে প্রায় আড়াই লাখ ডাউন শিশু আছে। ডাউন শিশু হলো এক ধরনের ক্রোমাজোমাল অ্যাবনরমালিটি। স্বাভাবিক ক্রোমাজোমের সঙ্গে অতিরিক্ত একটি ক্রোমোসোম চলে আসলে সেই জেনেটিক অ্যাবনরমালিটি হিসেবে জন্ম নেয়। ভ্রুণের ক্রোমোজোম বা জেনেটিক ত্রুটির মধ্যে ডাউন সিন্ড্রোম অন্যতম। ডাউন সিনড্রোম সম্পর্কে সচেতনতা না থাকায় দিন দিন দেশে ডাউন শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। বেশিরভাগ ডাউন শিশুর জন্মগত হার্টের সমস্যা থাকে বলে অনেক শিশু জন্মের পর মারা যায়, যা নবজাতকের মৃত্যু হার বাড়ায়। আর যারা বেঁচে থাকে, তারা মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে সংসার ও দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। প্রসবজনিত জটিলতায় মাতৃ মৃত্যুরোধের বিষয়টি যেভাবে প্রাধান্য পেয়েছে, অনাগত শিশুর ডাউন সিনড্রোমের মতো জেনেটিক বা জন্মগত ত্রুটির বিষয়টি সেভাবে আলোচনায় কখনও আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে গর্ভবতী মায়ের সেবা দেওেয়ার সময় মাকে ডাউন সিনড্রোম সম্পর্কে ধারণা দেওয়া চিকিৎসকের জন্য বাধ্যতামূলক হলেও আমাদের দেশে তা উপেক্ষিত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ১৫টি ডাউন শিশুর জন্ম হয়। নারী যত অধিক বয়সে মা হবেন, তার সন্তান ডাউন শিশু হবার সম্ভাবনাও তত বেশি হবে। যেমন- ২৫ বছর বয়সের প্রতি ১২০০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজনের, ৩০ বছর বয়সের প্রতি ৯০০ জন মায়ের মধ্যে একজনের ডাউন শিশু হতে পারে। কিন্তু ৩৫ বছর বয়সের পর ঝুঁকি দ্রুত বাড়তে থাকে। ৩৫ বছর বয়সের প্রতি ৩৫০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজনের এবং ৪০ বছর বয়সের প্রতি ১০০ জন মায়ের একজনের ডাউন শিশু হতে পারে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে মায়ের পেটে ১১ হতে ১৪ সপ্তাহের শিশুর ঘাড়ের পেছনের তরলের মাত্রা, গর্ভবতী মায়ের শরীরে ‘প্যাপ এ”, “বিটা এইচসিজি” নামক হরমোনের মাত্রা একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট তৈরি করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় জনপ্রিয় হবার কারণ হলো—  অনেকগুলো বিভাগ একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৭টি বিভাগ ও ১০৭টি কোর্স রয়েছে। আমাদের কোর্সগুলো আবার ইন্টার-রিলেটেড। সব বিভাগ ও কোর্সের শিক্ষক চিকিৎসকরা সমন্বয় করে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন।’

উপাচার্য আরও বলেন, ‘আজকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্মরণীয় দিন। গর্ভবতী মায়েদের যদি আমরা আরলি স্ক্রিনিং করতে পারি, তাহলে দেশের বার্ডেন কমানো সম্ভব। বার্ডেনটা কী?  এই অটিস্টিক শিশু বা ডাউন সিন্ড্রোম রোগী।  এসব রোধে আমাদের বিশেষজ্ঞরা মত দিয়ে থাকেন, বেশি বয়সে বিয়ে করা ঠিক হবে না। উপযুক্ত বয়সে বিয়ে হওয়া দরকার। ৩০ বছর বয়সে বা পরে যদি বিয়ে হয়, ৯০০ জন  মায়ের মধ্যে একজন ডাউন শিশু জন্ম গ্রহণ করবে। কিন্তু ৩৫ বছর বয়সের পর ঝুঁকি দ্রুত বাড়তে থাকে। ৩৫ বছর বয়সের প্রতি ৩৫০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজনের এবং ৪০ বছর বয়সের প্রতি ১০০ জন মায়ের একজনের ডাউন শিশু হতে পারে।’

উপাচার্য বলেন, ‘ডাউন শিশু চেনার উপায় হলো— শিশুর বুদ্ধি কম থাকে, নাক চ্যাপ্টা থাকে, কথা বলা দেরিতে শিখে, বসতে কষ্ট হয়, হাঁটতে দেরি হয়। তাদের জন্মের পর বাবা-মায়ের যেমন কষ্ট, সমাজের কষ্ট। কোনও শিশু যদি কনজেনিটাল ক্যাডল্যাক নিয়ে জন্ম হয়, তার যদি চিকিৎসা করা না হয়, ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত কষ্ট হয়। শিশুর জন্মের আগেই যদি আমরা ডাউন শিশু স্ক্রিনিং করতে পারি, তাহলে বাবামাসহ সমাজের কিছু মানুষকে কষ্টের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবো।’

উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘জন্মের পরে আমরা শিশুদের স্ক্রিনিং প্রকল্প শুরু করেছি। গবেষণার কাজে ১০০ কোটি টাকার প্রকল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৭টি প্রজেক্ট জমা হয়েছে। ওয়ান থার্ড প্রজেক্ট  আমরা পাবো বলে আশা করি। ভবিষ্যতে সেবায়, শিক্ষায়  ও গবেষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের  উন্নীত হবে।  বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। তিনি শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল করে দিয়েছেন।’