দেরি করেই বাড়ছে বিপদ

৭০ বছর বয়সী মোহাম্মদ মিজান ডেঙ্গু উপসর্গ নিয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানান ডেঙ্গু পজিটিভ। সঙ্গে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণও কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি শক সিনড্রোমে চলে যান। যার ফলে তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসকরা জানান, উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নিলে এই মৃত্যু ঠেকানো হয়তো সম্ভব ছিল। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারাই মৃত্যুবরণ করছেন, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে তারা দেরি করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য মতে, এ বছর এখন পর্যন্ত ১৭ হাজার ২৯৫ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর মারা গেছেন ৫৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা সেপ্টেম্বর মাসে। এই সংখ্যা ৩৪, যা এক মাসে করোনায় মৃত্যুর কাছাকাছি। এ বছর এখন পর্যন্ত যতজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৮৪৬ জন ও বেসরকারিতে ৬ হাজার ৩১৩ জন।

এছাড়া মৃত ৫৮ জনের মধ্যে ২৭ জনই ঢাকায় মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ১৩ জন সরকারি হাসপাতালে এবং ১৪ জন বেসরকারি হাসপাতালে। ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে। চট্টগ্রাম বিভাগে মৃত ২৫ জনের মধ্যে ১৯ জনই কক্সবাজারের।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, রাজধানীর হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভর্তি হয়েছে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল,  ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এই তিন হাসপাতালেই এই বছর সহস্রাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন সাত জন। আর শিশু হাসপাতালে মারা গেছে চার জন।

আক্রান্তের ৪৭ শতাংশই রোগী ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের। ৩৬ শতাংশ রোগী ঢাকা দক্ষিণ করপোরেশনের। আর ১৭ শতাংশ রোগী ঢাকার বাইরের।

মৃত্যুর তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ৪৭ শতাংশই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। ৩৭ শতাংশ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এবং ১৫ শতাংশ ঢাকার বাইরের। 

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশীদ উন নবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সময়মতো হাসপাতালে আসছে এবং চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে যাচ্ছে। তারপরও দুই একজন মারা যাচ্ছে। আমার হাসপাতালে তিন দিন আগে একজন মারা গিয়েছিলেন। তার আবার একইসঙ্গে অন্য দুটি রোগ ছিল। গতকাল একজন মারা গিয়েছেন ৭০ বছর বয়স্ক। তার ডেঙ্গুর পাশাপাশি ডায়বেটিস ও হাইপারটেনশন ছিল।

তিনি আরও বলেন, মানুষ সময়মতো যদি আসে আমাদের চিকিৎসায় কিন্তু সুস্থ হয়ে যেতে পারে। মানুষ যদি শক সিনড্রোমের আগেই চিকিৎসা নেওয়া শুরু করে তাহলে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। অনেক সময় রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়, রক্তক্ষরণ হয়। তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি হচ্ছে শক সিনড্রোম। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বাসায় বসে আছে, প্লাটিলেট কমে না, ব্লিডিং হয় না, কিন্তু শকে চলে গেছে। দেরি করে যদি আসে তাহলে সেক্ষেত্রে কিন্তু রিকভার করা অসম্ভব হয়ে যায়। এজন্য আমরা পরামর্শ দেই যে জ্বর আসলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং ফলোআপের ওপর থাকুন।

চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের উপসর্গ হলো শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া। ত্বক শীতল হয়ে যাওয়া। ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের ওপর লাল ছোপ সৃষ্টি হওয়া। বমি, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচণ্ড পেটব্যথা ও অনবরত বমি হওয়া, নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ও অবসাদ। কখনও মস্তিষ্কের ভেতর রক্তক্ষরণ হতে পারে।

ডেঙ্গু চিকিৎসায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করে তরল পানীয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. রোবেদ আমীন জানান, যেসময় থেমে থেমে বৃষ্টি হবে তখনই প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেবে। যদি কারও লক্ষণ দেখা দেয় তাদের অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রথম দিন যদি ডায়াগনসিস করা যায় তাহলে সবচেয়ে ভালো। ১০০টি ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ৯০টি মাইল্ড হয়। তারা বাসায় বসেই চিকিৎসা নিতে পারবেন।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন