ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদফতর-বিএমডিসিতে অভিযোগ

ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলার কারণে মো. বেলায়েত হোসেন নামে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়েছে। গত ৯ জানুয়ারি সকাল ৮টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। চিকিৎসকদের অবহেলায় বেলায়েত হোসেনের মৃত্যু হয় বলে দাবি করেছেন তার ছেলে মো. রাকিব উদ্দিন। বুধবার (৫ মার্চ) তিনি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়িত্ব অবহেলার দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এরপর দিন একই অভিযোগ জমা দিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে।

তবে এই প্রসঙ্গে এখনই মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।   

অভিযোগে মো. রাকিব উদ্দিন জানান, এখনও আমি মাকে আব্বার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানাতে পারিনি। হাসপাতালের অসতর্কতা আর অবহেলায় আমরা তাকে অসময়ে হারিয়েছি। আব্বার বয়স ৮০ বছরের কাছাকাছি। এই বয়সে ভালব রিপ্লেস করার দুটো উপায় ছিল। ওপেন হার্ট সার্জারি করে পুরো বুক কেটে সার্জিক্যাল ভালব বসানো। আরেকটি ব্যয়বহুল পদ্ধতি হচ্ছে— টাভি, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে পা দিয়ে ফুটো করে রিং পরানোর মতো করে ভালব বসানো হয়। এটি ব্যথাহীন বলে দাবি করা হয়।

রাকিব উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর টাভির প্রস্তুতির জন্য আব্বার বিভিন্ন টেস্ট করা হয়। তখন এনজিওগ্রামে তার আরও দুটি ব্লক ধরা পড়ে এবং আরও দুটি রিং বসানো হয়। এর আগে ২০১২ সালে একটি রিং ছিল, তিনটি রিং পরানোর পর টাভি ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তাও আমাদের খোলাসা করা হয়নি। চিকিৎসক বলেছিলেন, টাভি করা যেতে পারে। এই বয়সে ওপেন হার্ট সার্জারি ঝুঁকিপূর্ণ, আমাদের আগেই বলা হয়েছিল। গত ৭ ডিসেম্বর আব্বা ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন দুই দিনের পর্যবেক্ষণের জন্য। ৯ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় টাভি শুরু হয়।

রাকিব উদ্দিন দাবি করেন, শেষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি চিকিৎসকের নিয়ন্ত্রণেই ছিল না। এর ফলে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। তিনি অভিযোগে বলেন, সেদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার দিকে চিকিৎসক আমাদের জানান, সব ঠিক আছে, তবে একটি জায়গা থেকে সামান্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে, যা স্বাভাবিক। তারপর আব্বাকে সিসিইউতে নেওয়া হয়। হঠাৎ দেখি ডাক্তাররা ছোটাছুটি করছেন। আমার বোন যিনি ডাক্তার, জোর করে ভেতরে ঢুকে দেখেন আব্বা কলাপস করেছেন। তাকে সিপিআর দেওয়া হয়েছে, চারপাশে রক্ত পড়ে আছে। ডাক্তাররা বলেন, ইন্টারনাল ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না। কেন বন্ধ হচ্ছে না— এ বিষয়ে তারা স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি কেউ।

অভিযোগে রাকিব বলেন, টাভির প্রত্যাশিত রেজাল্ট না আসায় ওই দিনই রাতে আব্বার আরেকটি জটিল সার্জারির (ওপেন হার্ট) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেদিন বিকাল ৫টায় তাকে ওটিতে নেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে ওপেন হার্ট সার্জারি করে ব্লিডিং-এর উৎস খুঁজে বের করা হয়। দেখা যায়, টাভির ভালব বসানোর প্রক্রিয়ায় হার্টে একটি ফুটো হয়েছে, সেখান থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ৯ তারিখ রাতে ডাক্তার স্বীকার করেন, ভালব বসানোর সময় ওপরের দিকে খোঁচা লেগেছে। এরপর ২৪ ঘণ্টা হার্ট ওপেন রাখার পর ডাক্তাররা ১০ তারিখ রাতে আব্বার ব্লিডিং বন্ধ হওয়ার কথা জানান ও হার্ট বন্ধ করা হয়। কিন্তু ওপেন হার্টের পর আব্বার শরীরে নানা জটিলতা দেখা দেয়— ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট। পরে তাকে বাইপ্যাপ লাগানো হয়। তবুও তিনি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছিলেন না। কয়েক ধাপে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়। ৯ ডিসেম্বর রাত থেকে ১৮ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত কার্ডিয়াক আইসিইউতে ছিলেন। ১৮ ডিসেম্বর তাকে কেবিনে দেওয়া হয়। এখান থেকেই শুরু হয় ইউনাইটেডের চূড়ান্ত রকমের অবহেলা।

রাকিব বলেন, কোনও সুস্থ মানুষ মেনে নেবে না। যেমন- ক্রিটিক্যাল রোগীকে হুইলচেয়ারে করে বেডে দেওয়া হয়। কোনও ডাক্তার বা নার্স রোগীর ব্যাকগ্রাউন্ড জানতেন না। জুনিয়র নার্সরা দায়িত্বে ছিলেন, সিনিয়র কাউকে রাখা হতো না। ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর এই দুই রাত রুমে থাকার পর আব্বার অবস্থা আরও খারাপ হয়। আব্বার শ্বাসকষ্ট বাড়লে ২০ ডিসেম্বর তাকে আবার  কার্ডিয়াক আইসিইউতে নেওয়া হয়। ২০ ডিসেম্বর থেকে আব্বা সেখানেই ছিলেন। এরপর ডাক্তার আমাদের জানান, আব্বার চেস্টে ইনফেকশন হয়েছে, কিডনি বিকল হয়েছে, ডায়ালাইসিস লাগবে। অথচ আব্বার আগে কখনও কিডনির সমস্যা ছিল না।

লিখিত অভিযোগে রাকিব উল্লেখ করেন, ২১ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ১২ বার আব্বার কিডনি ডায়ালাইসিস করা হয়। মোট ১৬ ব্যাগ হোল ব্লাড এবং ১১ ব্যাগ প্লাটিলেট দেওয়া হয় আব্বাকে। এত রকমের জটিলতা ও রোগীর শরীর পুরোপুরি কলাপস করার পরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনও বোর্ড কল করেনি। দৃশ্যত, ডাক্তারদের ভেতরে কোনও রকমের সমন্বয় ছিল না। অতএব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে আমার আকুল আবেদন— এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ দায়িত্বরতদের অবহেলার জন্য বিচারের আওতায় আনা হোক। চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় যাতে কোনও সন্তানকে যেন আর তার বাবাকে না হারাতে হয়।

রাকিব উদ্দিনের অভিযোগের বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এখনই এই সম্পর্কে মন্তব্য করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা খোঁজ নিচ্ছি।