সূর্যমনির শহীদদের স্মরণে নেই কোনও স্মৃতিস্তম্ভ

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সূর্যমনিতে গণহত্যায় শহীদ হন অনেকে। তবে তাদের স্মরণে নির্মিত হয়নি কোনও স্মৃতিস্তম্ভ।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় সূর্যমনিতে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছে শহীদদের স্বজন ও মুক্তিযোদ্ধারা। এদিকে বধ্যভূমির জন্য যাও করা হয়েছে সেটাও এখন অরক্ষিত।

মঠবাড়িয়া সদর ইউনয়নের আঙ্গুলকাটা গ্রামে বাড়ি মঠবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের  সাবেক সহকারী কমান্ডার সুনীল মিত্রর।  আলাপকালে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর  বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টিকিকাটা ইউনিয়নের  রাজাকার কমান্ডার ইসকান্দার মৃধার (বর্তমানে প্রয়াত) নেতৃত্বে  ৫০ থেকে ৬০জন তাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। এ সময় রাজাকাররা তাদের বাড়িতে লুটতরাজ চালায়, বাড়ির মহিলাদের মারধর করে এবং তিনি ও তার বাবা, ভাইসহ বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, আমাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আলাপ আলোচনা হত। এজন্য মুক্তিকামী লোকজন জড়ো হতো আমাদের বাড়িতে। দিনটি ছিল লক্ষ্মীপূজার। এ দিন সন্ধ্যার দিকে  রাজাকাররা মঠবাড়িয়া শহরের বহেরাতলা এলাকার মাঝি বাড়ি থেকে তাণ্ডব শুরু করে। এ সময় তারা প্রথম হরেন মাঝি ও তার দুই ছেলে হিরেন ও জিতেন মাঝি ও একই বাড়ির সুধীর মাঝিকে ধরে পিছমোড়া করে রাস্তার ওপর বেঁধে রাখে।

তিনি জানান, এরপর তারা উত্তর দিকে হেঁটে বালাবাড়ি আক্রমণ করে। সে সময় তারা বালাবাড়ি থেকে কে এম লতিফ ইন্সটিটিউট এর শিক্ষক রবীন্দ্র নাথ বল ও বিনাপানি এলাকার সীতানাথ হাওলাদারকে ধরে রাস্তার ওপর বেঁধে রাখে। তাদের পাহারায়  থাকে এক একজন রাজাকার। এরপর তারা আরেক বালা বাড়িতে ঢুকে হিমান্ত বালা ও প্রিয়নাথ বালাকে ধরে। এরপর রাজাকাররা সামনের দিকে হেঁটে হাওলাদার বাড়ি আক্রমণ করে সেখান থেকে অনিল হাওলাদার ও আরেকজনকে ধরে। এরপর তারা হালদার বাড়ি আক্রমন করে প্রিয়নাথ হালদার, সুধাংশু, বিরাংশু হালদার ও  মধুসুদন হালদার ও আরেকজনকে ধরে রাস্তায় রাখে আর পাহারায় থাকে একেকজন রাজাকার। এরপর রাজাকাররা কীর্তনীয়া বাড়ীতে আক্রমণ করে নৃপেন কীর্তনীয়াকে ধরে বেঁধে রাখে।

এরপর তারা মাঠ পেরিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমাদের বাড়িতে ঢোকার আগে পাশে মণ্ডল বাড়ির ক্ষিরোধ মণ্ডলকে ধরে রাস্তায় বেঁধে রেখে কিছু দূরে থাকা আমাদের বাড়িতে যায়। তখন বের দিয়ে আমার বাবা উপেন্দ্রনাথ মিত্র, ছোট ভাই শৈলেন নাথ মিত্র, মনিন্দ্র মিত্র,মধুসূধন মিত্র ও আমাকে (সুনীল মিত্র),নগেন্দ্র নাথ মিস্ত্রি,ফনিভূষণ মিস্ত্রি, ভাণ্ডারিয়ার বিনোদ বিহারী হালদার ও তার ছেলে, সুরেন্দ্র নাথ, নিহার মুকুন্দ মিস্ত্রি ও তার ছেলে পরিমল মিস্ত্রিকে ধরে বেঁধে উঠানে রাখে। এরপর রাতেই সবাইকে এক সাথে করে মঠবাড়িয়া শহরের পৌরসভার শহীদ মিনারের কাছে নিয়ে রাস্তার ওপর বসিয়ে রাখে। এরপর রাজাকাররা শলা পরামর্শ করে।

সুনীল মিত্র জানান,আমার ভাই শৈলেন নাথ মিত্র তখন মঠবাড়িয়া কেএম লতিফ ইন্সটিটিউটে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। সে আমার পাশে বসা ছিল। ও অবস্থায় সে ফিসফিসিয়ে আমাকে বলতে ছিল, দাদা আমরা মনে হয় আর বাঁচতে পারবোনা । আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। সুনীল মিত্র বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর আমার সাথে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়েছেন আ. ছামাদ কমান্ডার। পরে আবার রাজাকারের দলে সে নাম লেখায়।

সে আমাকে দেখে বলেন, ‘গুরু তুমি এহানে  ক্যা?’ তখন আমি তাকে বলি, ‘তুমি তো আমাদের ধরে আনলা।’ এরপর সে আমাকে বলে , ‘বও(বসেন) দেখি কী করা যায়। কিছুক্ষণ পর সে এসে আমাকে ও আমার বাবাসহ ৭ জনকে  থানার সামনে ওয়াপদার একটি রুমে রেখে দেয়। আর আমার ভাইসহ অন্যদের রাজাকাররা থানায় নেওয়ার কথা বলে সূর্যমনি  বেড়িবাঁধ এলাকায় নিয়ে হত্যার উদ্দেশে গুলি চালায়। এ সময় গুলি খেয়েও ৮জন বেঁচে যায়। আর শহীদ হন ২২ জন।

সুনীল মিত্র জানান, পরদিন সকালে রাজাকারদের কাছ থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার বিষয়টি জানতে পারি। আমাকে ও আমার বাবাকে দুদিন পর রাজাকাররা ছেড়ে দেয়। মঠবাড়িয়া পৌরসভার বর্তমান মেয়র রফিউদ্দিন আহমেদ এর চাচা আফতাব উদ্দিন তালুকদার রাজাকারদের হাতে ৪ হাজার টাকা দিয়ে আমাদের ছাড়িয়ে আনেন। আর ওই রাজাকার আ. ছামাদ কমান্ডারকে যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে।

সূর্যমণি গণহত্যার ঘটনায় ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি মঠবাড়িয়ার সাবেক সংসদ সদস্য ও পিরোজপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এম,এ জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে প্রধান আসামি করে সাত জনের নামে মামলা করা হয়। এছাড়া মামলায় আরও ৬০/৬৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। ওই সময়ে সূর্যমণিতে রাজাকারদের গুলি খেয়ে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা জ্ঞানেন্দ্র মিত্র (৬২)(বর্তমানে প্রয়াত) বাদী হয়ে মঠবাড়িয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেছিলেন। আদালতের তৎকালীন বিচারিক হাকিম মো. কবির উদ্দিন প্রামানিক মামলাটি গ্রহণ করে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৬ (৩) ধারায় তদন্ত পূর্ববক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মঠবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)কে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। পরে পুলিশ মামলাটি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্দেশ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারভুক্ত করতে সুপারিশ করে। এ কারণে মামলাটি ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত হয়।

২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এনায়েতুর রহীম এর নেতৃত্বাধীন গঠিত ট্রাইব্যুনাল-১ এর আদালতে পলাতক যুদ্ধাপরাধী আব্দুল জব্বারের আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তবে ধরা পড়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন বলে শোনা গেছে।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার মঠবাড়িয়ায় পিস কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে বিশাল এক রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলেন। ৩৬ জন মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা, ৫৫৭টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ২০০ জনকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করাসহ ৫টি গুরুতর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। এছাড়াও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ঘোষিত ৫০ যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় তার নাম রয়েছে।

সুনীল মিত্র জানান, সূর্যমনি এলাকায় থাকা বধ্যভূমি সংরক্ষণে এখন পর্যন্ত যা কিছু কাজ হয়েছে  তার কৃতিত্ব মঠবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার  জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম জালাল এর। তবে এই বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ না হওয়ায় আমরা হতাশ।

মঠবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার  জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম জালাল জানান, আমি টিকিকাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালে চিন্তা করলাম একটা স্মৃতিস্তম্ভ করা দরকার।  তৎকালীন বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী আ.খ.ম জাহাঙ্গীর হোসেন মঠবাড়িয়ায় বিজয় মেলায় যোগ দিতে আসেন। তখন তিনি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে ওই ভিত্তিস্থাপনের পর আর কোনও কাজ হয়নি।

তিনি  জানান, বধ্যভূমির জায়গা ভরাট করার জন্য তৎকালীন সংসদ সদস্য মাহামুদা সওগাত দুই টন গম বরাদ্দ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ সময়ে যিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন তিনিও অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। তবে বধ্যভূমির জায়গা অরক্ষিত। সরকারের কাছে দাবি করছি, জায়গাটা সংরক্ষণ করে দ্রুত একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্য।

মঠবাড়িয়ার বাড়ইবাড়ীতে নির্মিত হচ্ছে স্মৃতিস্তম্ভ

বাড়ইবাড়ী বধ্যভূমিতে নির্মাণ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ

এদিকে মঠবাড়িয়ার শাপলেজা ইউনিয়নের নলী বাড়ইবাড়ী এলাকার  মুক্তিযোদ্ধা বিরেন্দ্রনাথ বাড়ই জানান, ১৯৭১ সালের ২১ জুন এ ইউনিয়নে তার বাবাসহ ১৩ জন শহীদ হয়েছেন। বাড়ইবাড়ী বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য আমি ১০ শতক জমি দিয়েছি। বর্তমানে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হচ্ছে। পিরোজপুর গণপূর্ত বিভাগ এটি বাস্তবায়ন করছে।

পিরোজপুর গণপূর্ত বিভাগের সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আব্বাস উদ্দিন জানান, জমি অধিগ্রহণের জটিলতায় সূর্যমনি বধ্যভূমিতে এবং মঠবাড়িয়া শহরের পোস্ট অফিস বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা যাচ্ছে না।

পিরোজপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার গৌতম চৌধুরী জানান, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় থাকা বধ্যভূমির মধ্যে পিরোজপুর শহরের বলেশ্বর ঘাট বধ্যভূমিতে অনেক আগেই শহীদ বেদী নির্মাণ করা হয়েছে।