পুলিশ বলছে, খেলার মাঠের সামনেই আজিজকে হত্যা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসকরা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আজিজের মাথার ডান পাশে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও বুকের বাঁ পাশে জখম ছাড়াও গোটা শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে গুরুতর আঘাত।
তেজগাঁও মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আটকরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আদালতের কাছে। এরা বেশ সহিংস। তবে এখন আর কেউ সক্রিয় থাকবে না।’
কিশোর আজিজ হত্যার ঘটনায় অবশ্য পুলিশকে দায়ী করছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, এরা মাদক বিক্রি থেকে শুরু করে মারামারি, নারীদের হয়রানি, ছিনতাই— সবই করে। কিন্তু পুলিশের এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই।
বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলের আশেপাশে গিয়ে জানা যায়, এ অঞ্চলে কমপক্ষে দুই ধরনের দল বা গ্যাং আছে। এদের কেউ কেউ মাদক বিক্রিতে জড়িত। এসব দলের বেশিরভাগ সদস্যই আশেপাশের ছোট কারখানা ও কাওরান বাজারে কাজ করে। এদের পরিবারও আশেপাশেই বস্তিঘর তুলে থাকে। আরেকদল একেবারেই ঘরহীন পথশিশু। এদের মধ্যে মারামারি লেগেই থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলপাড়ার এক কিশোরী বলেন, ‘এদের কেউই ভালো না। সবাই মারামারি করে। আমরা যারা বাসাবাড়িতে কাজ করি বা তরকারি টুকানির কাজ করি, তাদের নানাভাবে হয়রানি করে। সবাই জানে, কিন্তু কারও কিছু বলার নেই। তবে ওরা এতটা সহিংস, আগে বুঝিনি।’
এলাকায় কথা বলে জানা গেছে, চার ভাইবোনের মধ্যে আজিজের বয়স ১৭ বছর হলেও সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল তাকে। বড়দের সঙ্গেও সে মিশতে শুরু করে কম বয়সেই। রিকশা গ্যারেজে কাজ করে দিনে চার থেকে পাঁচশ টাকা আয় ছিল তার। কিন্তু ও কাদের সঙ্গে খেলতে যেত তা কখনও জানতে চায়নি কেউ।
একের পর এক কিশোরদের সহিংসতার ঘটনা কেন ঘটছে জানতে চাইলে মনোচিকিৎসক মেখলা সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব নতুন কোনও বিষয় না। এসব দলাদলি, বড় ভাই-ছোট ভাই সংস্কৃতি আমাদের সময়ও ছিল। কিন্তু ওই সময় এগুলো এতটা সহিংস ছিল না। আমাদের সময় কারও কখনও মনে হয়নি একজন আরেকজনকে মেরে ফেলবে।’
এখন কেন এই দলাদলি এত সহিংসতা রূপ নিয়েছে জানতে চাইলে মেখলা বলেন, ‘কারণ আমরা সঠিক প্যারেন্টিং বিষয়ে জানি না। একটি শিশু কিশোর হয়ে ওঠার সময় তার মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো ঘটে সেগুলো কিভাবে আমরা সামাল দেব তা নিয়ে ভাবি না। সন্তান যা চায় তা-ই তাকে দেওয়া যাবে না। আবার সন্তানকে ধমক দিয়ে, মেরেও কিছু শেখানো যাবে না।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের সমাজে প্যারেন্টিং ও স্কুলিং— দুই ক্ষেত্রেই চিড় ধরেছে। আমরা কিভাবে কতটা দিয়ে বা না দিয়ে শিশুকে গড়ে তুলব, সেটা বাবা-মাকে বুঝতে হবে। আবার স্কুলে শিশুকে যা শেখানোর কথা, শিক্ষকরা সেই দায়িত্ব পালন করছেন না ঠিকমতো। ফলে শিশুর বেড়ে ওঠার পথে সে টেলিভিশন, ভিডিও গেমস থেকে যা শিখছে সেটিকে বাস্তবতা মনে করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ধনী বা গরীব যে শ্রেণিরই হোক, পরিবারের জানার কথা তার শিশু কোন পথে যাচ্ছে, কোন জীবনাচরণে অভ্যস্ত হচ্ছে।’
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে যে বিদেশি সংস্কৃতি ঢুকে গেছে সেটিকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারলে একটা রূপ দাঁড়াত। আমাদের সন্তানেরা সেসব শিখে অন্য একটা জগত কল্পনা করে নিয়ে আচরণ করছে।’ এর কারণে হিসেবে তিনি আধুনিক যন্ত্রাদির নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে আরও বলেন, ‘নিজেদের মধ্যে অসততা থাকলে সন্তানকে সৎ করে গড়ে তোলা যায় না। আর বিচ্ছিন্নভাবে কোনও অভিভাবকের একার কাজও এটি নয়।’
আরও পড়ুন-
কে ‘বড় ভাই’, সেই দ্বন্দ্বে কিশোর খুন!
/টিআর/