রাজধানীর গুলিস্তানের মদিনাতুল মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে রবিবার (১৯ নভেম্বর) দিবাগত রাত দেড়টা থেকে দু’টার মধ্যে খুন হয় আব্দুর রহমান জিদান। রাতেই তার লাশ সেফটি ট্যাংকের ভেতর থেকে উদ্ধার করেন ওই মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
সোমবার (২০ নভেম্বর) সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গুলিস্তান আহাদ পুলিশ বক্সের পেছনে টিনশেড মদিনাতুল মাদ্রাসা। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মাদ্রাসাটিতে শিক্ষার্থীদের হেফজা (হাফেজি) পড়ানো হয়। মাদ্রাসার ভেতরেই শিশু-কিশোররা থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শতাধিক শিক্ষার্থী হাফেজি পড়ে। শিক্ষার্থীদের বয়স ৫ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে।
আমিনুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জিদান আর আবু বক্কর আগে বন্ধু ছিল। জিদানের বড় আবু বক্কর। তার হেফজা শেষ হয়েছে। এখন রিভিশন দিচ্ছে। তারা দু’জন এক সারিতেই ঘুমাতো। জিদানের বিছানার দু’জনের পর আবু বক্করের বিছানা। তাদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল। জিদানের সঙ্গে আমাদের মিশতে ও কথা বলতে নিষেধ করতো আবু বক্কর। এছাড়া আমাকে, জিদান, রিয়াজ ও ওসমানকে এর আগেও হত্যার হুমকি দিয়েছিল আবু বক্কর।’
এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা রাত সাড়ে ৯ টা থেকে ১০ টার মধ্যে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আবু বক্কর সবাইকে ঘুমিয়ে থাকতে বলে। রবিবার রাতেও প্রতিদিনের মতো খাবার খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। আমাদের সঙ্গে দুই শিক্ষক ছাত্রাবাসে থাকেন। তাদের মধ্যে মো. রাফসানি আমাদের বাংলা পড়ান। অন্য শিক্ষক মোহাম্মদ মিরাজ আমাদের নুরানি পড়ায়। রাফসানি হুজুর রবিবার রাতে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। অন্য হুজুর বাসায় গিয়েছিলেন। রাত দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে হাবিবুল্লাহ (১৩) ও মাইনুল ইসলাম (১৪) রক্ত রক্ত বলে চিৎকার দেয়। তখন হুজুর ঘুম থেকে ওঠেন। তিনি এসে লাইট জ্বালান। এরপর সবাই জেগে ওঠে। আমরা ঘুম থেকে উঠে দেখি জিদান ও আবু বক্কর নেই। দরজা খোলা। জিদানের বিছানায় রক্ত। তখন আমরা সবাই তাদের বাইরে খোঁজাখুঁজি করতে যাই। কিন্তু বাইরে কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে বাথরুমের পাশে সেফটি ট্যাংকির ভেতর থেকে জিদানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে আবু বক্করকে কোথাও পাওয়া যায়নি। সে দেয়াল টপকে পালিয়ে যায়।’
মাদ্রাসার বাবুর্চি হাবিবুর রহমান। সেফটি ট্যাংকি থেকে জিদানের লাশ উদ্ধারের সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ছাত্রাবাসের বাইরের একটি রুমে ঘুমাই। রাত ২টার দিকে আমাকে রাফসানি হুজুর ফোন দেন। আমি তার ফোন পেয়ে উঠি। তাকে জিজ্ঞাস করি, কী হয়েছে? তিনি বললেন, ছাত্ররা ঝামেলা করছে, আপনি আসেন। এরপর আমি দরজা খুলে বের হই। এরপর সবার সঙ্গে আমিও রক্ত দেখতে পাই। তখন আমিও ভড়কে যাই। জিদান ও আবু বক্করকে খুঁজতে যাই গুলিস্তান এলাকায়। তাকে না পেয়ে আমরা রক্ত দেখে দেখে ছাত্রদের নিয়ে সেফটি ট্যাংকির ভেতরে খুঁজি। এরপর দেখতে পাই জিদানের লাশ। তাকে তুলে প্রথমে আহাদ পুলিশ বক্সে নেই, এরপর সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।’
হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ফল কাটার ছুরি দিয়ে জিদানের গলা কেটে দেওয়া হয়েছে। সেফটি ট্যাংকিতে না ফেললে হয়তো ছেলেটা মারা যেতো না। তার মুখের ভেতরে কিছু দিয়ে নিয়েছিল বলে চিৎকারও করতে পারেনি।’ তবে হত্যাকাণ্ডের কারণ তিনি বলতে পারেননি।
এই ঘটনার পরও মাদ্রাসাটিতে শিক্ষার্থীরা আছে। ছোট শিশুদের চোখেমুখে আতঙ্ক। আলামত সংগ্রহের স্বার্থে মেঝে থেকে রক্ত এখনও মুছে ফেলা হয়নি। এই ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ফোন দিচ্ছেন। অনেকে এসে দেখেও যাচ্ছেন। এরই মধ্যে দু’জন শিক্ষার্থীকে অভিভাবকরা নিয়ে গেছেন।
মো. রুবেল নামে এক অভিভাবক তার ভাইয়ের শ্যালককে দেখতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘ঘটনা যেহেতু ঘটে গেছে, কী আর করা? হাফেজি পড়তে তো হবে। এই মাদ্রাসায় এমন ঘটনা আর ঘটেনি। এখন যেন নিরাপদে থাকে, সেজন্য খোঁজ নিতে এসেছি। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব, তারা যদি সবকিছু ঠিকভাবে চালায় তাহলে এখানে আমাদের ছাত্র থাকবে।’
হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে পল্টন থানা পুলিশ। জিদানের বিছানার পাশে ঘুমিয়ে থাকা চার শিক্ষার্থী রাফিউল (১০), রিয়াজ (১৩), হাবিবুল্লাহ (১৩) ও কামরুল (১৪) কে থানায় নিয়ে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এছাড়া তিন জন শিক্ষককেও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূলত সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব নিয়েই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবারও আবু বক্কর ও জিদানের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল। এর জের ধরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে আমাদের ধারণা। আমরা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘নিহতের স্বজনদের খবর দেওয়া হয়েছে। তারা ঢাকাতে এলে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ হস্তান্তর করা হবে। এ বিষয়ে মামলা প্রক্রিয়াধীন। আবু বক্করকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
ভিডিওতে গুলিস্তানের মদিনাতুল মাদ্রাসা: