বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট নিয়ে আইনজীবীদের দুই মত

 

সুপ্রিম কোর্টবিচারকের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণ-সংক্রান্ত শৃঙ্খলাবিধির গেজেটে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতেই রাখা হয়েছে। এছাড়া, নিম্ন আদালতের যেকোনও বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টকে এককভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিষয়টি ‘পরামর্শক্রমে’ তা রাষ্ট্রপতিকে জানাতে বলা হয়েছে। এই বিধিমালার কারণে বিচার বিভাগে নতুন করে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন আইনজীবীদের একাংশ। তবে অন্যপক্ষের  মতে, এই গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছিল, তার অবসান হয়েছে।   

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭ নামের প্রকাশিত এই গেজেটে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে রাখা হয়েছে ৩ (জ) অনুচ্ছেদ অনুসারে। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ অর্থ রাষ্ট্রপতি বা তৎকর্তৃক সংবিধানের ৫৫(৬) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রণীত Rules of Business-এর আওতায় সার্ভিস প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় বা বিভাগ। 

সংবিধানের এই ৫৫ (৬) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি সরকারি কার্যাবলি বণ্টন ও পরিচালনার জন্য বিধিগুলো প্রণয়ন করবেন।’

এছাড়া গেজেটের ৩ (ছ) অনুচ্ছেদে দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ বলতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সার্ভিস সদস্যদের প্রশাসনিক বিষয়ে স্থানীয় নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে বোঝানো হয়েছে। 

গেজেটের এই বিধানটি নিয়ে কথা হয় ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজিমের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গেজেটের পুরো অংশ দেখে শেষ করতে পারিনি। তবে যতটুকু দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে, আগে যা ছিল তাই আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গেজেটে সুপ্রিম কোর্টের একচ্ছত্র ক্ষমতা যা ছিল, তা আর নেই। এখন কোনও বিষয়ে দ্বিমত হলে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি আবার সেই বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে পাঠাবেন। এমন টানাপড়েন থেকেই গেলো।  গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে শুধু দায়সারা কাজটাই করা হলো।’

তবে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘মাসদার হোসেন মামলার পরে নিম্ন আদালতের নিয়োগ পদ্ধতিটা একেবারেই সুপ্রিম কোর্টের হাতে। তাই সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বলতে এই নয় যে, প্রধান বিচারপতির সঙ্গেই পরামর্শ করতে হবে। তবে এই গেজেটে অসুবিধা আছে বলে মনে হলে, তা সংশোধন করা যেতে পারে। যদি এমন বিধান থাকে যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তবে সেটা সংশোধন করা যেতে পারে। তবে এই গেজেট নিয়ে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। আমার মনে হয়, বিধি প্রকাশের পর ভুল বোঝাবুঝির কোনও অবকাশ নেই।’

এদিকে একই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন কোনও কথা বলবো না। যা বলার আগামীকাল (বুধবার) সংবাদ সম্মেলনে বলবো। ’

তবে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘গেজেট নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে বিতর্ক সমালোচনা-আলোচনা থাকতেই পারে। গেজেট প্রকাশে কোর্টে অনেকবার সময় নেওয়ার পর এটি যে প্রকাশি হলো, সেটাই বড় প্রাপ্তি। তাই এটা বলা যায় যে, অবশেষে গেজেটটি প্রকাশিত  হয়েছে। এখন এর ভালো-মন্দ দিক আলোচনার মধ্য দিয়ে এর পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও পরিবর্তন হতে পারে।’

তবে সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলছেন ভিন্ন কথা। তার মতে, ‘মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ও সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে নিম্ন আদালতকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোটের সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু এ গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সে জায়গা থেকে সরে গেছে। এর মাধ্যমে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে গেছে।’

প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেওয়া হয়। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। সেই নির্দেশনা অনুসারে বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন না করায় আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে পর্যন্ত গত বছরের ১২ ডিসেম্বর তলব করেছিলেন আপিল বিভাগ।

এরপর চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধি গেজেট আকারে প্রকাশ করতে সরকারকে বার বার সময় দেন আপিল বিভাগ। কিন্তু কয়েক দফা সময় নিয়েও গেজেট প্রকাশে ব্যর্থ হয় সরকার। 

এ বিষয় নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে আইনমন্ত্রীর আলোচনায় বসার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। পরে বিষয়টি নিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাসহ আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা শেষে আইনমন্ত্রী গেজেট প্রকাশ শিগগিরই হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন। তবে আইনমন্ত্রী এই ‌ মাসের ৩ তারিখের মধ্যে গেজেট প্রকাশের কথা বললেও সোমবার (১১ ডিসেম্বর)  এই গেজেট প্রকাশিত হয়।